"প্রচারেই প্রসার" ব্যাবসা করতে হলে কথাটি মনে প্রাণে মানতেই হবে। না মানলে লোকসান যেটা হবে তা হল, আপনি আপনার জায়গাতেই থাকবেন কিন্তু বাকি সবাই আপনাকে ছেঁড়ে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। ফলাফল কেউ না কেউ খুব সহজেই আপনার মার্কেট পজিশনটা নিজের করে নিবে এবং আপনার কাস্টমাররা খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে ভুলে যাবে।এই কথাগুলি ইন্ডিয়ান মোটরসাইকেল কোম্পানি বাজাজ আটোর থেকে ভালো আর কে বুঝে! ইন্ডিয়ান বাইক নিয়ে যত এড আছে , বাজাজ নিঃসন্দেহে সবার থেকে এগিয়ে। তাদের বাইকগুলি বিশ্বমানের কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে , কিন্তু তাদের বিজ্ঞাপনগুলি বিশ্বমানের এ বিষয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নাই। তাদের এডগুলি আপনাকে ভাবাবে, আকৃষ্ট করবে এবং তাদের প্রোডাক্ট কিনতে অনুপ্রাণিত করবে। আর এখানেই তো প্রচারের সার্থকতা।
বেশ কিছুদিন আগেই উত্তরা মোটর্স বাংলাদেশে এই বাইকটির ১৫০ সিসির মডেলটি আনার ঘোষণা দিয়েছে। খবরটি শুনেই প্রায় ১০ বছর আগের দেখা বাজাজ এভেঞ্জারের এডের কথা মনে পড়লো। এই এডটি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল ইন্ডিয়াতেও। এডের ক্যাপশান ছিল “Feel Like God”। মূলত এই ক্যাপশান নিয়েই ছিল ব্যাপক আলোচনা।কারনও আছে, হিন্দু মিথলজিতে প্রতিটি দেব দেবীরই নিজেস্ব বাহন আছে। যেমন দূর্গার বাহন সিংহ, কার্তিকের ময়ূর , মহাদেবের ষাঁড় বা গনেশের ইঁদুর। এখন প্রশ্ন হলো এই বাইকটি কি দেবতাদের বাহনের মতো বিশ্বস্ত, শক্তিশালী নাকি বাইকটি চালালে দেবতাদের মতো মনে হবে নিজেকে। আগেই বলে নেই এভেনজার সিরিজের বাইকগুলি আইকনিক। তাদের ২২০, ২০০, ১৮০ এবং ১৫০ দেখতে প্রায় একই রকমের।
যাই হোক আমরা মুল বিষয়ে ফিরে আসি, কথা বলছিলাম এভেঞ্জারের এড নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো এড এ কোন সেলিব্রেটি নাই, সেক্সি কোন নারী নেই এমন কি বাইকের কোন স্পেসিফিকেশান ও নাই, শুধু আছে বাইকটির সাথে একটা তরুণ ছেলে এবং বাইকটি চালিয়ে তার অনুভূতি এক কথায় Simple enough। এডটি গোটা ইন্ডিয়াতে আলোড়ন তুলে দিয়েছিল। এড এ দেখা যায় একজন সপ্রতিভ মাচো (macho) তরুণ একটা কালো টি- সার্ট এবং কালো জিন্স পড়ে পাহাড়ী রাস্তায় বাজাজ এভেঞ্জার চালাচ্ছে। যখন সে বাইকটি চালাচ্ছে তার মনে পড়ে তার বাবা একবার তাকে জোরে চড় মেরেছিল, এই অংশটি সাদা কালো, ব্যাকগ্রাউন্ডে ঠাস করে চড়ের শব্দ ভেসে আসে। এডটি বর্তমান সময়ে নিয়ে আসে আবারে। ছেলেটি তার গালে হাত বুলায় এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে শব্দ ভেষে আসে “I forgive my dad”. এর পরেই দেখা যায় একজন তরুণীকে বিয়ের পোশাকে। আবারো সাদা কালো এবং সঙ্গে সঙ্গেই সময়কে আবার বর্তমানে নিয়ে আসা হয়। তরুণ বাইকার তার বাম হাতের রিং ফিঙ্গারের দিকে তাকায় এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে শব্দ ভেসে আসে “I forgive women”. এড টি এগিয়ে যায় এবং পরের অংশে দেখা যায় তার বস মুখের উপরে একগুচ্ছ কাগজ ছুড়ে মেরে তাকে কাজ থেকে বের করে দেয়। এডের এই অংশে বাইক ড্রাইভ করতে করতে তার মাথা সরিয়ে নেয় যাতে বসের ছূড়ে দেয়া কাগজ তার মুখে না লাগে পেছন থেকে কন্ঠ বলে উঠে “I forgive my boss”. এর পরে দেখা যায় বাইকটি রাস্তার একটা গর্তে পরে হালকা ঝাঁকুনি খায়। সেই বাইকার তরুণ পেছন ফিরে গর্তটি দেখে এবং কণ্ঠটি আবার বলে উঠে “I forgive the government”. এর পরে তার মনে পড়ে নাপিত একবার সেভ করতে গিয়ে তার ঠোট কেটে দিয়েছিল। তরুণ বাইকার জিব্বা দিয়ে কাটা অংশটি ছোঁয় এবং কন্ঠটি বলে উঠে “I forgive my barber” । এর পরে দেখা যায় স্থানীয় কিছু কৃষক উপুড় হয়ে মাঠে কাজ করতে করতে পিঠের ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । তখন কন্ঠটি বলে উঠে “I feel……. I feel like….”. এর পরে সে আকাশের দিকে তাকায় তখন কন্ঠ বলে উঠে “I feel like god”. এডটি সত্যাই অসাধারণ। কোন সন্দেহ নাই অনেক তরুণই এই এডটি দেখে বাইকটি কিনতে প্রলুব্ধ হবে।
দশ বছর পরে বাজাজ অটো তাদের এভেঞ্জার সিরিজে যেমন কিছু পরিবর্তন এনেছে এডটিকেও নতুন করে সাজিয়েছে। নতুন এই এডটিতে মুল থিম ঠিক রেখে কর্পোরেট জীবনের ৯-৫ টা শৃংখলিত জীবনের ইদুর দৌড় থেকে মুক্তি চাওয়া কিছু তরুণদের নিয়ে করা। নতুন এডের ক্যাপশান 'Feel Like God' rat race. এই এড প্রসঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে সুমিত নারাং (Sumeet Narang) বাজাজ অটোর Vice President - Marketing বলেন ," আমরা এভেঞ্জার সিরিজকে নতুন ভাবে সাজিয়েছি Avenger - Cruise 220 এবং Street 220 ও 150 আর এই বাইকগুলি প্রথম দিন থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। । তিনি বলেন আপনি যখন এই বাইক চালাবেন তখন গোটা পৃথিবি আপনাকে তাকিয়ে দেখবে। বাইকের কন্ট্রোল থাকবে আপনার হাতের মুঠোয়, তা যে ভিড়ে ভরা শহুরে রাস্তাই হোক বা হাইওয়ে, দেবতাদের মতোই সব কিছু সহজ মনে হবে। এর DTS-i ইঞ্জিন সাথে টুইন স্পার্ক প্লাগ আপনাকে রাইডের সময় এক্সট্রা পাওয়ার দিবে। এর পেছনের মোটা টায়ার আপনাকে যেকোনো রাস্তাতেই স্টেবল রাইডের অনুভূতি দিবে সাথে এর নিচু সুপ্রস্থ সিট লম্বা রাইডের অনুভুতিকে স্বর্গীয় করে তুলবে । এর লম্বা হুইল বেজ আপনাকে পারফেক্ট ক্রুজার অনুভূতি এনে দিবে। আর কি চাই। তিনি যোগ করেন প্রাত্যহিক কমিউটার বাইক হিসাবে যেমন চমৎকার তেমনি লম্বা ড্রাইভে পারফেক্ট এডভেঞ্চারের উপযোগী করে বাইকটি ডিজাইন করা। কাস্টমারদের সাথে কথা বলে জেনেছি তারা লং রাইডে বাইকের কার্যক্ষমতায় মুগ্ধ । আর যারা কমিউটার হিসাবে এই বাইক ব্যবহার করেন তারা জানিয়েছেন এই আসলে তাদের মুক্তির স্বাদ দিয়েছে।"
এডের নতুন এই সংস্করনে আপনার দেখবেন একজন তরুণ তার এভেঞ্জার বাইক নিয়ে শৃঙ্খলা মুক্ত জীবনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছে । এই শৃংখল জীবনের আরও প্রাপ্তির জন্য প্রতিযোগিতা; প্রতিযোগিতার এই "ইঁদুর দৌড়" এক সময় যেন জীবনের স্বাধিনতাকেও কেড়ে নেয়। এই এড যেনো তরুনদের বলছে অনুভব কর দেবতাদের মতো। এই এডে মূলত কর্মজীবি কর্পোরেট প্রফেশনাল তরুণদের দেখানো হয়েছে। যারা প্রফেশনাল তীব্র প্রতযোগিতা বা "Rat Race" এ ব্যাস্ত। দুটি প্যারালাল জার্নি দেখানো হয়েছে। একদিকে দেখা যাচ্ছে এক যুবক এভেঞ্জার নিয়ে কর্ম ব্যাস্ত শহর ছেড়ে দুরে বহু দুরের পথে রয়েছে অন্যদল আক্ষরিক অর্থে কর্পোরেট কর্ম ব্যাস্ত ইঁদুর। গমগমে একটি কন্ঠ তখন বলছে 'rush hour race', 'big chair race', 'race for money', 'race for fame' 'Employee of the month'. অন্যদিকে তখন এভাঞ্জার চালক যুবকের মুখে তাচ্ছিলের হাসি। পেছন থেকে কন্ঠ বলে উঠে 'The rat race is yours, and everything else is mine'. এড শেষ হয় 'I feel like God' উক্তির মধ্য দিয়ে। বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এভেঞ্জারে উঠলেই নিজেকে আপনার দেবতার মত মনে হবে।
এভেঞ্জারে সিটে বসলে নিজেকে দেবতার মতো মনে হবে কিনা জানি না । কারণ বাইকটি এখনো বাংলাদেশে আসেনি , তবে দেবতার অনুভূতি কেমন তা জানার জন্য বাইকটি পেলে আপনার চালাতে ইচ্ছা করবে নিশ্চয়। এখানেই এই এডের সার্থকতা। সাধারণ মানুষকে প্রলুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
উল্লেখ্য বাজাজ ২০০৫ সালে Eliminator নামে কাওয়াসাকির একটি প্রোডাক্ট বাজারজাত করে। ব্যপক সাফল্যের পরে সেটি বন্ধ করে দিয়ে সেই বছরের ১০ই জুন তারা Avenger নামে নতুন সিরিজ চালু করে রাহুল বাজাজ এর জন্ম দিনে। যেটি দেখতে Eliminator এর মতোই ছিলো। এটি ছিলো Bajaj Avenger 180 যেখানে তাদের আরেকটি জনপ্রিয় সিরিজ পালসারের ১৮০সিসি DTS-i ইনজিন ব্যবহার করা হয়। Avenger 180 এর ব্যাপক সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ২০০৭ সালে Avenger 200 নিয়ে আসে। যেখানে Oil Coling সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। পরিবর্তীতে আরো আপগ্রেড ভার্সন Bajaj Avenger 220 মডেলটি আনা হয় ইনজিন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যপক পরির্তন করে। Bajaj Avenger 150 Street তাদের সর্বশেষ সংজোযন তাদের Avenger সিরিজে। ইনডিয়াতে এটিকে সবচেয়ে কম সিসি ইনজিনের কম দামের ক্রুজার বলা হচ্ছে।
আমাদের দেশে ক্রুজার বাইক বলতে ইয়ামাহা এন্টিসার, কীওয়ে সুপারলাইট, রিগ্যাল র্যা পটর এর দুই একটা মডেল চোখে পড়ে। ইয়ামাহা এন্টিসার খুব অল্প পরিমানেই এসেছিলো তার পরে আর আসেনি। অন্যদিকে কীওয়ে এর এই সেগমেন্টের বাইক নতুন এনেছে। আমাদের দেশে ক্রুজার সেগমেন্টের বাইক এখনো তেমন জনপ্রিয় না হলেও ইন্ডিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয়। সেখানে বাজাজ এভেঞ্জারকে মোকাবেলা করতে হবে “রয়েল এনফিল্ড” এর মতো শক্তিশালী আর জনপ্রিয় ব্যান্ডের সাথে। তাই এডে দেখানো অনুভূতি যদি এভেঞ্জার রাইডাররা পান তবে বাইকটি ব্যাপক মার্কেট পাবে কারণ রয়েল এনফিল্ড ইন্ডিয়াতেও একটা দামী ব্রান্ড। আমাদের দেশে বাইকটি যদি সহনীয় দাম রাখা হয় আর পাফর্মেন্স যদি ভালো হয় তবে আসা করা যায় বাংলাদেশী কাস্টোমার মুখ ফিরিয়ে নিবে না।