প্রযুক্তি মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ এবং সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রযুক্তি আরও উন্নতি লাভ করছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি একটি নতুন হেডলাইট সিস্টেম আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে যা কিনা সরাসরি ইঞ্জিন এর সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ ইঞ্জিন চালু করলে হেডল্যাম্পটি অন হবে ইঞ্জিন বন্ধ করলে হেডল্যাম্পটি বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন এই প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে
Automatic Headlamp ON (AHO)। ইঞ্জিন চালু হওয়ার সাথে সাথে হেডল্যাম্পটি জ্বলে উঠবে এবং যেহেতু হেডল্যাম্পটি সবসময় জ্বলতে থাবে সেহেতু হেডল্যাম্প অন/অফ এর কোন বাটন থাকবে না।সম্প্রতি আমরা Automatic Headlamp ON (AHO) সম্বন্ধে অবগত হই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার কাছ থেকে। তাদের দেশে ২০১৭ সাল থেকে প্রত্যেক দ্বিচক্রযানে এই প্রযুক্তি থাকবে। এই AHO ফিচারটির ফলে বিপরীত দিক থেকে আসা অন্যান্য বাহনের চালক খুব সহজেই আপনার অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারবে। অতিরিক্ত কুয়াশা এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এই ফিচারটি দুর্ঘটনার মাত্রা কমিয়ে নিয়ে আনবে। AHO ইউরোপের দেশগুলোতে ২০০৩ সাল থেকে প্রচলিত আছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তিটি এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করেছে। খুব সম্প্রতি ইয়ামাহা মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড তাদের FZS-fi 2017 তে এই AHO ফিচারটি যোগ করেছে। Yamaha FZS-fi 2017 তে চড়েই AHO বাংলাদেশের প্রবেশ করেছে। ইয়ামাহা মোটরসাইকেল এর ফিচারটি অন্যান্য মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড অবলম্বন করার পথে। প্রযুক্তির এই নবতর ব্যবহারটি কি আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য বা কার্যকরী? আসুন প্রতিবেদনটির সাথে থেকে বিষয়টি পরিস্কার হই।
AHO কি?
AHO বা Automatic Headlight On হলো সেই সিস্টেম যেখানে দিন হোক বা রাত ইঞ্জিনের সাথে সাথে হেডলাইটও জ্বলে উঠবে। অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, মোটরসাইকেলের সাথে হেডলাইট অন/অফ এর অপশন থাকবে না। কারণ এটি সাধারণভাবেই ইঞ্জিন এর সাথে অন হবে। হাই-বিম এবং লো-বিম সাথে পাস লাইটটি সংযুক্ত থাকবে।
AHO কেন?
এই প্রযুক্তির প্রধান কারন হল নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিকভাবে বহু দেশে অনুসরণ করা হয়। কিছু কিছু সময় এই প্রযুক্তিটি দুর্ঘটনারোধে অনেক সহায়ক ভুমিকা পালন করে থাকে। যদিও সারা দিন ব্যাপী হেডলাইট অন করে রাখার পেছনে অনেক মতানুবাদ রয়েছে। (AHO) মূলত শীত প্রধান দেশ কে কেন্দ্র করে তৈরী করা। শীতপ্রধান দেশে প্রচুর পরিমাণ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকাটা স্বাভাবিক। তুষারপাত এবং মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকার ফলে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে। সূর্যের আলোর ঘাটতি মিটাতে মূলত শীতপ্রধান দেশে এই (AHO) ফিচারটি বেশী পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও সেসকল দেশে ভালো রাস্তা এবং দ্রুতগতি সম্পন্ন গাড়ী হওয়াতে মোটরসাইকেলের মতো বাহন অনেক বড় গাড়ীর চালকের দৃষ্টিতে সহজে ধরা পড়ে না। তাই মোটরসাইকেলগুলোকে সর্বাবস্থায় হেডলাইট জ্বালিয়ে চালাতে হয় যেন বড় এবং দ্রুতগতির গাড়ী তাদেরকে দেখতে পায়, অথবা অবস্থান বুঝতে পারে। এই ফিচারটি স্বল্প আলো যেমন সূর্যাস্তের সময়, সূর্য উদয়ের সময় এবং মেঘাচ্ছন্ন দিনে অনেক সহায়ক হয়। বিশেষ করে শীত প্রধান দেশে সারাদিনই কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় AHO খুবই কার্যকর।
DRL কি AHO এর পরিবর্তে ব্যবহার হতে পারে?
AHO এর পরিবর্তে অনেক কোম্পানি তাদের হেডলাইটে DRL (Day-time Running Lights) প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সাধারণত এটি ছোট আকৃতির এবং বিশেষ ধরনের উজ্বল আলোর এলইডি লাইট, যেটি দিনের বেলাতে গাড়ী চলতে থাকলে অন থাকে যা অপরদিকের আগত গাড়ীকে দেখতে পারে। এটি AHO এর মত কাজ করে না, কারণ হলো হেডল্যাম্পের এই ছোট আকৃতির এলিডি লাম্পের তুলানায় AHO অনেক বেশী আলো তৈরী করতে পারে। তবে আলো কম হলেও এটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে এবং ব্যাটারী বা ইনজিনের উপরে কম চাপ ফেলে।
পুরোনো মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে AHO
ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে সরকার এবং সড়ক ও জনপদ মন্ত্রনালয় যদি AHO বাধ্যতামুলক করে থাকে, সেক্ষত্রে পুরোনো মোটরসাইকেল যাদের AHO প্রযুক্তি নেই, তাদের চিন্তিত হবার কারনও নেই। মোটরসাইকেল চলার সময় হেডলাইটের আলো জ্বালিয়ে চালালেই চলবে।
AHO এর খারাপ দিক
প্রত্যেকটি ভাল প্রযুক্তির কিছু খারাপ দিক থাকে। রাস্তায় চলাচলকৃত দ্বিচক্রযানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই AHO। তবে কিছু কিছু সমস্যাও তৈরী করে যেমন-
ব্যাটারির উপর প্রভাবঃ AHO এর ফলে ব্যাটারি উপর অতিরিক্ত চাপ বেড়ে যায় এবং ক্ষয় বেশী হয়।বেশিরভাগ আধুনিক মোটরসাইকেলে উন্নতমানের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারি ব্যবহার করা হয় যেটা AHO এর চাপ নিতে সক্ষম।
পরিবেশের উপর প্রভাবঃ বিশ্ব উষ্ণতার একটি কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই AHO। হাজার হাজার মোটরসাইকেল আরোহী হেডলাইট অন করে ঘুরে বেড়ালে পরিবেশ মারাত্মকভাবে উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে।
ইঞ্জিনের পারফরমেন্সের উপর প্রভাবঃ অন্যদিকে সব সময় হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখার ফলে ব্যাটারিকে চার্জ দেয়া বা হেডলাইটে সার্বক্ষনিক বিদ্যুত সরবরাহ করতে গিয়ে ইঞ্জিনের উপর আলাদা চাপ সৃষ্টি হবে এর ফলে গতি এবং মাইলেজ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ইঞ্জিনের স্থায়ীত্বের কথা মাথায় রেখে ম্যনুফ্যাকচারদের উচিত AHO এর বিকল্প এবং কার্যকরী কিছু খুজে বের করা।
অন্যান্য প্রভাব: AHO ব্যবহার করার পূর্বশর্ত হল প্রত্যেক মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচার এর উচিত হেডলাইটের আকারটা রি-ডিজাইন করা এবং আকারটা এক ধরনের করা। বিভিন্ন আকারের হেডল্যাম্প রাস্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।দিনের বেলা বিভিন্ন মোটরসাইকেলের ভিন্ন আকৃতির হেডলাইটে জ্বলতে থাকা আলো বিপরিত দিকের গাড়ীর চালককে বিভ্রান্ত করে দিবে।
বাংলাদেশে AHO এর প্রয়োজনীয়তা
AHO প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছিলো শীতপ্রধান দেশে যেখানে দিনের বড় অংশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে, রয়েছে বড় বড় এবং দ্রুত গতির গাড়ী। ফলে তাদের জন্য মোটরসাইকেলের মতো ছোট গাড়ী সমস্যার কারন হয়ে দাড়ায়। কিন্তু গ্রীষ্মপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। শীত কালে সর্বোচ্চ ১সপ্তাহ থেকে ২সপ্তাহ ঘন কুয়াশা থাকে। ভালো রাস্তা না থাকায় কোনো গাড়ীই অধিক গতিতে চলতে পারে না এবং সবচেয়ে বড় কথা দিনের আলোতে যেখানে ১কিমি এরও অধিক দূরের একটি মোটরসাইকেলকে দেখা যায় সেখানে AHO এর মতো প্রযুক্তি কতটুকু দরকার তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত ইনজিন সেগমেনট হলো ১০০সিসি। ১৫৫সিসি ক্ষমতার বেশি ইনজিন অনুমোদিত নয়। যেখানে ইনজিনের সব ক্ষমতার বেশিরভাগ ব্যয় হয়ে যায় মোটরসাইকেলের গতি তৈরী করতে সেখানে প্রতিমুহুর্তে ৩৫ওয়াট বা তারও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বাল্বকে জ্বালিয়ে রাখলে ব্যাটারী/ইনজিন সব কিছুর উপরেই অতিরিক্ত চাপ পড়বে। ইনজিনের ক্ষমতা কমবে, জ্বালানি খরচ বাড়বে।
বাংলাদেশে যেখানে প্রতি বছরেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে দেশজুড়ে যদি লাখ লাখ মোটরসাইকেলের আলো জ্বালিয়ে চলা শুরু হয় তাহলে তাপমাত্রা কোন অবস্থায় যাবে তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে ব্যস্ততম শহরে যেখানে জ্যাম বেশি সেখানে দুপুরের রোদে হাজারো মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো কি পরিমান কষ্টদায়ক হবে তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
পরিশেষে, বলা যায় যে AHO সিস্টেমটি আমাদের দেশের জন্য খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই তবে এটি অতিরিক্ত নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। DRL সিস্টেমটি AHO এর পরিবর্তেও ব্যবহার করা যেতে পারে । আমাদের দরকার উন্নতমানের সড়ক, ভাল ট্র্যাফিক ব্যবস্থা, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং সচেতনতা। আমরা যদি একটু সচেতনতার সাথে ড্রাইভ করি এবং ট্র্যাফিক নিয়ম কানুন গুলি মেনে চলি তবে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।