পিচঢালা প্রশস্ত রাস্তা থেকে শুরু করে নুড়ি পাথরের বন্ধুর পথ ধরে কমলা আর কালো রঙা মোটরসাইকেলটি এমন অসীম বেগে চলে যেটার দুর্দান্ত গতিকে বাহবা দেয়ার আগে আপনি থমকে থাকবেন কিছুক্ষণ। তবে, সম্ভাবনা অনেক বেশি যে এর মধ্যেই দু’চাকার এই যান আপনাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেছে কিংবা তার উল্লাস মুখর গর্জনে আপনার স্তুতিবাক্য হয়তো শোনাই যাবে না। তা যা ই হোক না কেন, একথা নিশ্চিত যে তিন অক্ষরে-‘কেটিএম’ খোদিত চোখ ধাঁধানো এই মোটরসাইকেলটি দেখার পর এর প্রশংসা না করে আপনি থাকতে পারবেন না।
পিওরিটি, পারফর্মেন্স, অ্যাডভেঞ্চার এবং এক্সট্রিম
এই চারটি হচ্ছে বিশ্বখ্যাত অস্ট্রিয়ান মোটরসাইকেল প্রতিষ্ঠান কেটিএম এজির প্রধান মান নির্ধারক। ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে এর প্রতিটি মডেলে এ চারটি বিষয়ের সুসংহত সমন্বয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে অতিসামান্য অটো মেরামতের দোকান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এর পর বহু দশক ধরেই মোটরসাইকেল স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এ ব্র্যান্ডটি। বিশ্বযুদ্ধে পুরো ইউরোপীয় মার্কেটে ধ্বসনামার ঠিক কিছুদিন আগে প্রকৌশলী জোহান হ্যানসট্রানকেন পোলজ অস্ট্রিয়ার ম্যাটিগোফেনে ‘ ডিকেডব্লিউ’ মোটরসাইকেল এবং ‘ওপেল’ গাড়ি বিক্রির উদ্দেশ্যে তার ক্ষুদ্র উদ্যোগটি শুরু করে ছিলেন।
অনেক বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ব্যবসায়ী আর্নেস্ট ক্রোন রেইফ একে একটি সুগঠিত কাঠামো প্রদানের পর, ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি ‘ক্রোনরেইফ অ্যান্ড ট্রানকেন পলজ ম্যাটিগোফেন’ (সংক্ষেপে কেটিএম) নামে নিবন্ধিত হয়। ম্যাটিগোফেন আজও এই সফল যাত্রা শুরুর ইতিহাস বহন করে চলেছে। কেটিএমের সদর দপ্তর এখনো সেখানে অবস্থিত যেখানে এর সূচনা হয়েছিলো।
আর ১০০, আর ১২৫ এবং ট্রফি ১২৫ মডেল দিয়ে কেটিএম ’৬০-র দশকের গোড়ার দিকে বাইকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছিল। দুই প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পরে, হ্যানসট্রানকেন পলজের পুত্র এরিকট্রানকেন পলজ ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওজনে হালকা হলেও চলবে ক্ষিপ্র গতিতে এ লক্ষ্যে আমেরিকান মোটরসাইকেল ডিস্ট্রিবিউটর জন পেন্টন কেটিএমের সাথে যুক্ত হন। এরপরে, পেন্টন-কেটিএম জুটি শীঘ্রই পেন্টন ১০০ এবং পেন্টন ১২৫ এর অবিস্মরণীয় সাফল্য দেখতে পান এবং এ সাফল্য কেটিএম জিএস ১২৫ তৈরির পথকেও করে সুপ্রশস্ত। বিশ্ব জুড়ে ইঅফ-রোড অনুরাগীদের জন্য একটি সময়োত্তীর্ণ মডেল বলে স্বীকৃত।
রেসিং পাওয়ার হাউজ
অপ্রতিরোধ্য গতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কেটিএম ’৮০-র দশকের মধ্যে ইঅফ-রোড মোটর সাইকেল ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষে আরোহণ করেছ। এরই মধ্যে মোটরসাইকেল স্পোর্টস পুরো ইউরোপ জুড়ে বিনোদনের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং কেটিএম এর মোটরসাইকেল গুলো ধারাবাহিক ভাবে নানা খেতাব অর্জন করেছিল। কেটিএম এর ডার্ট বাইকের অপ্রতিরোধ্য স্বভাব একে বড় বড় সব অফ-রোড মোটরসাইকেল রেসিং, যেমন এন্ডুরো ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, মোটোক্রস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, ইউএস রেস সিরিজ, ড্যাকার র্যা লী ইত্যাদিতে এখনো দাপিয়ে বেড়াতে সক্ষম করে তুলেছে। ২০০১ থেকে শুরু করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, কেটিএম ড্যাকা র্যা লীর প্রতিটি রাউন্ড জিতেছে। এই রেকর্ড ভাঙ্গা অন্য কারো পক্ষে প্রায় দুঃসাধ্য বলা চলে।
কেটিএম রেসিংএর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি। তাই,প্রতিটি কেটিএম এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যা প্রত্যেক কেটিএম রাইডারের বাইক চালানোর ভঙ্গিকে দেয় বিশেষ স্বকীয়তা।
প্রত্যেক কেটিএম কর্মকর্তা এবং প্রো-রাইডারের দুর্দান্ত মনোবলের ফল সবরূপ তিনশোরও বেশি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব কেটিএমের গ্যালারিতে এখন শোভা পাচ্ছে। কেটিএম ইঞ্জিনিয়াররা প্রতিটি মোটরসাইকেল সুকৌশলে ডিজাইন করেন। যান্ত্রিক ত্রুটিহীনতা তথা পিউরিটির খাতিরে প্রতিটি স্ক্রু যেমন শক্ত থেকে শক্ততর করে লাগানো হয়েছে, তেমনি এর প্রতিটি জয়েন্ট নিখুঁত পারফর্মেন্স উপহার দিতে যথেষ্ট পরিমাণে গ্রিজ করা। এর প্রধান লক্ষ্য হল অ্যাডভেঞ্চারে অনুপ্রাণিত করা এবং উৎকর্ষে পৌঁছাতে অদম্যপ্রাণ শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। কেটিএম ইউএসএ, কেটিএম ইউকে, কেটিএম ইন্ডিয়া, কেটিএম রাশিয়া, কেটিএম আফ্রিকা এবং কেটিএমএশিয়া – বিশ্বব্যাপী এই ডিভিশন সমূহের পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কেটিএমের তিন হাজারের ও অধিক কর্মী রয়েছে। পিয়েরের মোবিলিটি এজি এবং বাজাজ অটো বর্তমানে কেটিএমের মূল শেয়ার হোল্ডার। এটি বিশ্বজুড়ে ৮০টিরও বেশি দেশে মোটরসাইকেল বাজারে একটি প্রভাবশালী ব্র্যান্ড হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ডিউকের উত্থান
কমলা আর কালো রঙা দুর্দান্ত গতির মোটরসাইকেল টির ডিউক সিরিজের মাধ্যমে শহুরে রাস্তায় এর আগমনী হুংকার তোলে। অ্যাডভেঞ্চার আর নিখুঁত পারফর্মেন্স অনুরাগী শহুরে বাইক চালকেরা খুঁজে পায় তাদের চলার পথে নতুন সঙ্গী। অভিনব এই মোটরসাইকেলটি একই সাথে রেসিং বাইকের মত অসাধারণ গতি সম্পন্ন আবার নিত্য ব্যবহার উপযোগী মোটরসাইকেলের মতো এর হ্যান্ডেলবার ওপরে থাকায় এটি চালানোর ভঙ্গি স্বাচ্ছন্দ্য দায়ক এবং এটি সহজে প্রতিদিন কার চলাফেরায় ব্যবহার বান্ধব। ডিউক সিরিজটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের সকল ব্র্যান্ড এবং মডেলের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ। এ সিরিজটি ১২৫ সিসি থেকে শুরু করে ১২৯০ সিসির সুপার ডিউক আর পর্যন্ত বিভিন্ন রেঞ্জে পাওয়া যাচ্ছে।
“থিংক গ্লোবাল, অ্যাক্ট লোকাল” এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কেটিএম বাংলাদেশেও পাওয়া যাবে। দেশীয় ব্র্যান্ড রানার অটোমোবাইলসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কেটিএম তাদের নতুন যাত্রার পথ আরও সুগম করেছে। কেটিএম বাংলাদেশের মোটরসাইকেল প্রেমীদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে। এর চমৎকার এবং অভিনব মোটরসাইকেল গুলো খুব শীঘ্রই আনুষ্ঠানিক ভাবে এই দেশে যাত্রা শুরু করবে এবং বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাবে।