মোহাম্মাদ সাদিকুল্লাহ। সবার কাছে “জুন” নামে পরিচিত। “জুন-বাইক-ট্যুর” এই তিনটি শব্দ একে অপরের সাথে মিশে আছে। চলাচলের জন্য সাধারনত তিনি সব সময়েই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে থাকেন। সে অফিস যাওয়া হোক, গ্রামের বাড়ী দিনাজপুর হোক বা পাশের দেশ ইনডিয়া-নেপাল হোক। বাইক তার সাথে থাকা চাই। ১দিনে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, ৫দিনে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমন, এমনকি ৪হাজারেরও অধিক পথ পাড়ি দিয়ে ইনডিয়া পার হয়ে হিমালয় কন্যা নেপাল পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন বাইকে চেপে। সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন মোটরসাইকেল ভ্যালী অফিসে। তার সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার বাইক জীবনের কথা, ভ্রমনের কথা, বাইকের প্রতি ভালো লাগার কথা। টীম মোটরসাইকেল ভ্যালীর কৌতূহলী কিছু প্রশ্নের জবাব যেন “জুন” ভাই । আসুন জেনে নেই এই মোটরসাইকেল প্রেমী মানুষটির মোটরসাইকেল প্রেমের কথা।
মোটরসাইকেলভ্যালী: আপনার মোটরসাইকেল জীবন শুরুর গল্পটি বলুন?
জুন সাদিকুল্লাহ: এটা খুব সম্ভবত ২০০৬ কিংবা ২০০৮ সালের দিকের ঘটনা, আমি ই পি জেড এর গার্মেন্টস সেক্টরে জব করতাম এবং সেই অফিস থেকে একটা গাড়ি পেয়েছিলাম। সেই জন্য মোটরসাইকেলের তেমন একটা প্রয়োজন অনুভব করতে পারিনি। আমার কর্মস্থল ছিল আমার বাসা থেকে বেশ দূরে কিছু দিন পর আমি আমার কর্মস্থল পরিবর্তন করে ঢাকা উত্তরায় আসি। আমি তখন কল্যাণপুরে খালেক পেট্রোল পাম্প এর পেছনে থাকতাম। আমি পাবলিক বাসে চেপে অফিসে যাতায়াত করতাম। এভাবে যাতায়াত করতে করতে আমি মোটরসাইকেলের প্রয়োজন অনুভব করলাম এবং আমার বন্ধুকে ব্যপারটা জানালাম। আমি আমার বন্ধুর কাছ থেকে জানতে চাইলাম যে কিস্তিতে কে বা কারা মোটরসাইকেল বিক্রয় করে থাকে। তারপর জানতে পারলাম সিঙ্গার কোম্পানি কিস্তিতে মোটরসাইকেল দিচ্ছে। তারপরে চলে গেলাম সিঙ্গার এর শোরুমে এবং একটি ১০০ সিসির মোটরসাইকেল পছন্দ করি। মোটরসাইকেলটির দাম ছিল প্রায় ৫৬০০০ থেকে ৬০০০০ এর মত কিন্তু তখন আমার কাছে এত টাকা ছিল না। আমি ব্যাপারটা আমার পিতামাতা এবং আত্মীয়স্বজনদের জানালাম এবং তাদের সহযোগিতায় আমি মোটরসাইকেলটা কিস্তিতে কিনলাম। আমার এক বন্ধুর দুলাভাই সিঙ্গারের শো রুমে চাকুরী করতেন তার সহযোগিতায় কিস্তির বিষয়টা আরও সহজ হয়ে যায়। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে অফিসে যাতায়াত করতাম। কিছুদিন পর আমি ভাল শক্তিশালী ইঞ্জিন এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। এরপর আমি বাজাজ পালসার ১৫০ সিসি বাইকটি কিনলাম তখন বাইকটা আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। পালসার থাকা সত্ত্বেও আমি লং ট্যুরে যেতে ভয় পেতাম কারণ হল বাইকটির টিউবলেস টায়ার ছিল না। তার কিছুদিন পর আমি ইয়ামাহা এফযেডএস বাইটা নিলাম। এই বাইকটা ছিল আমার চালানো বাইকগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা একটি বাইক।আমি এই বাইক নিয়ে আমার ওয়াইফ সাথে প্রথম লং ট্যুরে বান্দরবান গিয়েছিলাম।
মোটরসাইকেলভ্যালী: ১ দিনে ১০০০ কিমি ( টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া) ট্যুরের উদ্দেশ্য কি ছিল?
জুন সাদিকুল্লাহ: এটা আসলে ৯৬৭ কিমি এর মত ছিল। আমার ভ্রমন করতে খুব ভাল লাগে এবং ভ্রমনের প্রতি আমার অন্য রকম এর এক অনুরাগ আছে। সেই জন্যই আসলে এই ট্রিপ তবে অন্য কোন অভিপ্রায় ছিল না। আমার হোমটাউন দিনাজপুর এবং আমি আমার বাইক নিয়ে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাই এবং কোন কোন সময় সেই দিনেই ফিরে আসি তাই এই ট্যুর টা কোন ভাবেই একটা বড় ইস্যু নয়। এছাড়াও রাইডিং এর সময় আমি ফিজিকাল বা মেন্টাল কোন সমস্যার সম্মুখীন হইনি। আমি তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই যারা এই ধরনের লং ট্যুর করতে আগ্রহী যে, প্রথমত রাইডারকে দীর্ঘ সময় রাইডিং করার অভ্যাস থাকতে হবে। লম্বা ট্যুর করার ক্ষেত্রে রাইডার কে ক্রমে ক্রমে রাইডিং অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, ২০০-৩০০ কিমি এর মত চালাতে পারলে রাইডার এর জন্য রাইডিং বেশ সহজ হয়ে যাবে। রাইডার এবং যানবাহনের জন্য রেস্ট নেওয়া টা খুব দরকার এবং সেই সাথে বেশী বেশী বিশুদ্ধ পানি পান করা খুবই প্রয়োজন।
মোটরসাইকেলভ্যালী: ৫ দিনে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমনে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি ছিল?
জুন সাদিকুল্লাহ: আমি যখন আমার ভ্রমনটা শুরু করি তখন বরিশাল বিভাগ সম্পর্কে আমার কোন ধারনা ছিল না এবং এটা ছিল আমার ভ্রমণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বরিশাল বিভাগের প্রত্যেকটি শহর গুলো একে অন্যের সাথে খুব কাছাকাছি অবস্থিত এবং ভিন্ন ভিন্ন রাস্তার সাথে সেই শহর গুলো সংযুক্ত। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাবার অনেক পথ রয়েছে তাই মহাসড়ক অনুসরণ করতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমি ম্যাপ দেখে উপজেলা গুলো সিলেক্ট করলাম এবং তারপর ভ্রমন শুরু করলাম। একটা বড় রহস্যময় ঘটনা ঘটেছিল সিলেট সুনামগঞ্জে। সেখানে একটা রাস্তা দেখতে পেলাম যেটা শুধু মাত্র শীতকালে দেখা যায় তাছাড়া অন্যান্য মৌসুমে এই রাস্তাটা পানির নিচে থাকে। আমি সৌভাগ্য ছিলাম কারণ আমি আমার ভ্রমণ শুরু করেছিলাম শীতকালে সেইজন্য রাস্তাটা দেখতে পেরেছি। সমস্ত ট্রিপ টা খুব একটা বড় ট্রিপ ছিল না। আমরা যেমনটা বলেছিলাম যে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ১০০০ কিমি এর সাথে প্রায় ২০০০ কিমি বা ৩০০০ কিমি যোগ করলেই সমস্ত ট্রিপ এর হিসাব বোঝা যাবে। ৪০০০ কিমি এর কাছাকাছি রাইড করছি এবং আপনি এর মধ্যেই ৬৪ জেলা ঘুরতে পারবেন, শুধু দরকার ম্যাপ কে ভাল করে অনুসরণ করা এবং সঠিক পথ বেছে নেওয়া। আমি চেষ্টা করেছিলাম এই ট্রিপ ৪ দিনের মধ্যে শেষ করার কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আমি বেশী সময় নষ্ট করে ফেলেছিলাম এর মধ্যে নদীনালা, পানি এবং রাস্তা একটা বড় সমস্যা ছিল।
মোটরসাইকেলভ্যালী: কক্সবাজার থেকে হিমালয়(কাঠমুন্ডু) ভ্রমনের স্মরণীয় মুহূর্ত কি ছিল।
জুন সাদিকুল্লাহ: স্মরণীয় মুহূর্ত গুলো কথা বলতে গেলে অনেক গুলো স্মরণীয় মুহূর্ত কথা রয়েছে। একটি কে বাদ দিয়ে অন্যটি বলা যায় না কারণ সম্পূর্ণ ভ্রমনে আমার সবকিছু অনেক ভাল লেগেছে। এর থেকে বিশেষভাবে বলার কিছু নাই ।আমার পুরো ভ্রমণটা অনেক স্মরণীয় ছিল।
মোটরসাইকেলভ্যালী: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোটরসাইকেলে বিদেশ টুরে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?
জুন সাদিকুল্লাহ: আমি এক কথায় বলব এটা অনেক জটিল একটি বিষয়। কাগজপত্র বা ভিসার জন্য তেমন কোন সমস্যা হয় না তবে প্রধান সমস্যা হয় আমাদের বর্ডারে কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের বর্ডার পার হওয়ার প্রক্রিয়াটা অনেক জটিল। আমরা যখন ভ্রমন শুরু করলাম তখন এই ঝামেলা বুঝতে পারলাম। বর্ডারে আমরা যখন কাস্টম কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং এন বি আর এর চিঠি দেখালাম তখন উনি বললেন অল্প কিছুক্ষন সময় লাগবে “দয়া করে অপেক্ষা করুন”। এরপর তিনি আমাদের ডেপুটি কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কাগজপত্র দেখার পর ডেপুটি কমিশনার আমাদের অনেক গুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন এবং এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করার জন্য তিনি আরেকজন ভদ্রলোক কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। সেই প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। সমস্ত ফরমালিটিস শেষ করার পর আমরা বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া ঢুকে পরি। আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম যে বাংলাদেশে বর্ডার পার হতে একদিন সময় লাগল কে জানে এখানে কতদিন লাগবে।কারনেটের হলুদ কার্ড দেখানোর পর থেকে ইন্ডিয়ার বর্ডারের অফিসারগুলো আমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে লাগল।অফিসার তার রুমে নিয়ে গিয়ে একটি ফর্ম তিনি নিজ হাতে পুরন করলেন এবং সেখানে আমাদের স্বাক্ষর প্রদান করতে বললেন। এতে সময় লেগেছিল মাত্র ১০ মিনিট এবং ইমিগ্রেশনের জন্য এক্সট্রা ৫ মিনিট লেগেছিল। ১৫ মিনিট সেখানে কাটানোর পর আমার চলে গেলাম কোলকাতায়। ইন্ডিয়া থেকে ফেরত আসার পথে আবার বাংলাদেশের বর্ডারে আগের মতই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
আসলে এর প্রধান কারণ হল কারনেট। কারণ তারা মনে করে যে কারনেট দিয়ে বিভিন্ন রকমের ক্রাইম এবং বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তারা কারনেট এর প্রকৃত মানে জানে না।
মোটরসাইকেলভ্যালী: লং ট্যুরের ক্ষেত্রে একজন মোটরসাইকেল রাইডারের কি কি বিষয়ের উপরে লক্ষ্য রাখা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
জুন সাদিকুল্লাহ: আমি আগেও বলেছি যে, লং ট্যুরের জন্য একজন রাইডারের অবশ্যই প্র্যাক্টিস এবং শক্ত মনোবল থাকতে হবে এর ফলে রাইড করা অনেক ইজি হয়ে যাবে। প্রথমত রাইডারের দীর্ঘ সময় রাইড করার অভ্যাস থাকতে হবে এবং বড় ট্যুর এর ক্ষেত্রে রাইডারকে ক্রমে ক্রমে কিছু ছোট খাটো ট্রিপ দিতে হবে। ২০০ কিংবা ৩০০ কিমি ট্রিপ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সময় মত রাইডার এবং তার বাহনের রেস্ট নেওয়াটা একটি বড় বিষয় থেকে যায়। যতটুকু সম্ভব বেশী বেশী করে পানি পান করতে হবে । এছাড়াও কিছু সেফটি গিয়ার থাকা অত্যান্ত জরুরী যেমন, fast-aid box, tool box এবং বাইক ঠিক করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ইত্যাদি সঙ্গে রাখতে হবে।
মোটরসাইকেলভ্যালী: আপনি দীর্ঘদিন থেকে লিফান কেপিআর বাইকটি ব্যবহার করছেন, এই নিয়ে ভাল মন্দ কিছু দিক আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
জুন সাদিকুল্লাহ: আমি মনে করি যে সমতল রাস্তা জন্য লিফান কে পি আর বাইকটি যথেষ্ট ভাল। আমাদের দেশে বেশির ভাগ রাস্তা গুলো সমান্তরাল যার ফলে এই বাইকটি ভাল পারফর্মেন্স দিবে। হাইওয়েতে আমার স্পীডের প্রয়োজন যেটা এই বাইক অনায়াসেই দিয়ে থাকে স্পিডের পাশাপাশি এর হেডল্যাম্প ভাল পারফর্মেন্স দেয়। কিন্তু গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স এবং স্যাডেল্টি আরও ভাল হতে পারত এবং বাইকটি অফ রোডের জন্য উপযোগী নয়। এই টাইপের দামের মধ্যে লিফান অনেক ভাল পারফর্মেন্স দেয়।
মোটরসাইকেলভ্যালী: বাংলাদেশে মোটরসাইকেলে সিসি লিমিট সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
জুন সাদিকুল্লাহ: আমার নিজস্ব মতানুসারে বাংলাদেশে সিসি লিমিট অন্তত ২৫০সিসি করা দরকার। আমরা সকলেই মনে করি যে সিসি হচ্ছে ভাল স্পীডের জন্য কিন্ত আমাদের সেফটির দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। রাইডিং এর ক্ষেত্রে সেফটি অনেক বড় একটি ব্যপার। ভাল স্পীডে বাইক চালানো ভাল, তবে সেফটি বাইক চালানো বাইকারের জন্য সম্মানজনক একটি ব্যাপার। আমরা যদি দেখি যে ৩০০ সিসির বাইকগুলো যেমন ইয়ামাহা আর ৩, হোন্ডা সি বি আর ২৫০ এসব বাইক গুলো সেফটি ফিচার হিসেবে (এ বি এস) ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের ব্রেকিং অনেক ভাল রাইডিং এবং সেইফটি নিশ্চিত করে। সেই রকম ভাবে ( AHO) হল আরেকটি সেফটি ফিচার।
মোটরসাইকেলভ্যালী: আগামীতে লং ট্যুরের কোন প্ল্যান আছে?
জুন সাদিকুল্লাহ: আমি ভ্রমণের জন্য শীতকালকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকি। সব কিছু ঠিক থাকলে ইনশাআল্লাহ্ সামনের ঈদে নেপাল যাওয়ার একটি পরিকল্পনা আছে। কারণ স্বল্প ছুটির জন্য নেপাল অনেক ভাল প্লেস এবং কাছে প্রায়। এছাড়া ইন্ডিয়ার লাদাখে ভ্রমনে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু লাখাদ জায়গাটি ইন্ডিয়ার বর্ডারের একদম শেষ দিকে অবস্থিত তাই এখানে যেতে হলে ১৫ থেকে ২০ দিন হাতে নিয়ে যেতে হবে। যদি আমি আমার অফিস থেকে অন্তত ২০ দিনে কোন ছুটি পাই তবে আমি সোজা লাদাখে চলে যাব বেড়াতে।
আমি আগেও বলেছি যে বাংলাদেশের বর্ডারে কারনেট একটা বিরাট সমস্যা তাই যদি যেতেই হয় তবে বর্ডার থেকে কার কাছে থেকে বাইক ধার করে নিয়ে তারপর যাব।
মোটরসাইকেলভ্যালী: আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
জুন সাদিকুল্লাহ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।