বর্তমান সময়ে আমরা সকলেই সারা বিশ্বব্যাপী মোটরসাইকেলের ব্যপক জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করছি। ভাল ও সন্তোষজনক পারফরমেন্সের জন্য প্রস্তুতকারক কোম্পানী গুলো মান সম্পন্ন ইঞ্জিন এবং উন্নতমানের পার্টস সরবরাহ করছে। এর কারণ হল ইঞ্জিন কে মোটরসাইকেলের জীবন বলে বিবেচনা করা হয় এর জন্য এটির ইঞ্জিন ভাল হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারন হল ইঞ্জিনের পারফরমেন্স। বিভিন্ন ক্যাটাগরি এবং বিভিন্ন সেগমেন্টের বাইক আমাদের দেশে বিদ্যমান এবং সেই সাথে বিভিন্ন ক্যাটাগরি এবং সেগমেন্টের ইঞ্জিনও বিদ্যমান।প্রায় প্রত্যেকটি তৈরিকৃত মোটরসাইকেলে গ্যাসোলিন ইন্টারনাল কম্বুশন ইঞ্জিন রয়েছে যেটা হতে পারে টু-স্টোক কিংবা ফোর স্টোক ইঞ্জিন। আমরা সকলেই জানি যে মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন জ্বালানির সাহায্যে চলে এবং এই জ্বালানী বার্ন করার জন্য ইঞ্জিনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। তাই ইঞ্জিন ঠান্ডা রাখার জন্য মোটরসাইকেলে ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেমের প্রয়োজন হয় যেমন- এয়ার কুল্ড, লিকুয়িড কুল্ড বা অয়েল কুল্ড। এটা নির্ভর করে আপনি কীভাবে বা কী রকম রোড কন্ডিশনে বাইক চালাচ্ছেন তার উপর। এই কুলিং সিস্টেমের কিছু বিশেষ দিক রয়েছে যেটা ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে এবং যার ফলে এই কুলিং সিস্টেমগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরির বাইকের সাথে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
এই দুটি কুলিং সিস্টেম বিভিন্ন ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা ভাবে প্রয়োজন পড়ে। আসুন জেনে নেই ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেমে কাজ এবং এর ব্যবহার।
এয়ার কুল্ড মোটরসাইকেল ইঞ্জিন
মোটরসাইকেলের এয়ার কুল্ড ইঞ্জিন বলতে সাধারণত রাইডিং এর সময় বাইরের বাতাসের সাহায্যে ইঞ্জিন ঠান্ডা করার প্রক্রিয়াকেই বোঝায় যেটা বাইক রাইডিং করার সময় পারিপার্শ্বিক বাতাস হতে ইনজিনকে ঠান্ডা করা হয়। এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনেরভাল দিক হল এটি খুব ভালভাবে তাপগুলোকে শুষে নিতে পারে,যার ফলে ইঞ্জিন পার্টস গুলো বেশী তাপমাত্রায় খুব ভাল পারফরমেন্স দিয়ে থাকে। এই ধরনের ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেম চরম তাপমাত্রাযুক্ত এলাকা যেখানে বেশী ঠান্ডা কিংবা গরম থাকে সেই এলাকার জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক সময় দেখা যায় যে ধরনের ইঞ্জিনের মাথায় একটি ফ্যান থাকে এবং এই ফ্যানের সাহায্যে ইঞ্জিনের ভেতরের গরম বাতাস বাইরে বের করে দেয় কিন্ত এটি সাধারণত হাই সিসি বা হাই পারফরমেন্স বাইকগুলোর ক্ষেত্রে বেশী ব্যবহৃত হয় ।
লিকুয়িড কুল্ড মোটরসাইকেল ইঞ্জিন
লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিন ঠান্ডা রাখতে এক্সটা পানি বা লিকুয়িড ব্যবহার করতে হয়। এই ধরনের ইঞ্জিনের হিট কে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ইঞ্জিন কুলেন্ট ব্যবহার করা হয়। এই ইঞ্জিন কুলেন্ট ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় এবং সম্পূর্ণ ইঞ্জিনে এটি ছড়িয়ে যায় এবং ইঞ্জিনের হিট শুষে নেয় । কিছু কিছু সময় দেখা যায় যে ট্যাংকারের সাথে একটি ছোট আকারের ফ্যান সংযুক্ত থাকে কারণ হল কিছু সময় রেডিয়েটোরের এয়ার ইনফ্লো ভাল ভাবে হয় না এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই ফ্যান বাইরের বাতাসগুলোকে ভেতরে ভাল ভাবে সরবরাহ করে এবং বাড়তি হিট বের করে দেয়।
অয়েল কুল্ড মোটরসাইকেল ইঞ্জিন
অয়েল কুলিং সিস্টেম হল আরেকটি ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেম যেটা সাধারনত সব মোটরসাইকেলে দেখা যায় না। কিছু কিছু সময় লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিনে কুলেন্ট হিসেবে অয়েল ব্যবহার করতে দেখা যায় যেখানে ইঞ্জিন কুলেন্ট হিসেবে কাজ করে। ওয়েল কুল্ড ইঞ্জিনে বাতাস এবং পানির পরিবর্তে অয়েল কুলেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায় এবং এটি সাধারণত ইঞ্জিনের ভেতরের গরম তাপমাত্রা কে সেই অয়েল এর মাধ্যমে বাইরে বের করতে সাহায্য করে। ইঞ্জিনের ভেতরের গরম তাপমাত্রাকে এই অয়েল কুল্ড সিস্টেম কমিয়ে দেয় এবং ইঞ্জিনকে ভাল পারফরমেন্স দিতে সাহায্য করে। বিভিন্ন মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক কোম্পানী বিভিন্ন কারণে এই ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেমটি ব্যবহার করে আসছে। এলাকা, আবহাওয়া, এবং বিভিন্ন বিষয়ের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতকারক কোম্পানীরা বিলাসবহুল বা হাই পারফরমেন্স বাইকগুলোতে এই সিস্টেমটি ব্যবহার করছে।
এয়ার কুল্ড এবং লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিনের পার্থক্য
এই দুই ধরনের ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেম বেশ নির্ভরযোগ্য ও প্রশংসনীয় কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনটি বেশী পছন্দের সেটা বলা একটু কষ্টকর।এয়ার কুল্ড এবং লিকুয়িড কুল্ড এই দুই ধরনের ইঞ্জিন বিভিন্ন কন্ডিশনের উপর ভিত্তি করে ভাল মন্দ কিছু দিক রয়েছে। এয়ার কুল্ড ইঞ্জিন সিস্টেমটি কম আরপিএম এ ভাল পারফরমেন্স দিয়ে থাকে যার ফলে বাইকের তেল সাশ্রয়ী বেশী হয়। অন্যদিকে লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিনে কমপ্রেশন রেশিও বেশী থাকায় হাই আরপিএম এ ভাল পারফরমেন্স দেয় সেজন্য লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিনের মাইলেজ খুব একটা বেশী পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ হাই সিসির বাইকগুলোতে লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিন থাকায় বেশ ভাল পারফরমেন্স পাওয়া যায় এবং স্পীড নিয়ে তেমন ভাবতে হয় না।
যদি কোন ব্যাক্তি হাই ক্যাপাসিটি ইঞ্জিন এবং বাড়তি মেইন্টেনেন্স খরচ করার আগ্রহ থাকলে তাদের জন্য এই দুটি ইঞ্জিনের মধ্যে যে কোন একটি নিশ্চিত ভাল হবে। কিন্ত যদি কোন কারনে কোন ব্যাক্তি অতিরিক্ত মেইনটেনেন্স করার আগ্রহ না থেকে তবে তার জন্য এয়ার কুল্ড ইঞ্জিন বেছে নেওয়াটাই বেস্ট হবে। এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনের মেইনটেনেন্স খরচ খুবই সামান্য এবং কোন প্রকার দুশ্চিন্তা থাকে না। কিছু কিছু সময় লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিন ঝামেলার সৃষ্টি করে যেমন কুলেন্ট ড্যামেজ, কুলেন্ট লিকেজ ইত্যাদি । সুতরাং গ্রাহকরা যদি এয়ার কুল্ড ইঞ্জিন বেছে নেয় তবে তাদের কোন এক্সটা ঝামেলা পোহাতে হবে না।
অন্যদিকে ওয়েল কুল্ড সিস্টেমটি কম তাপমাত্রা এলাকার জন্য এবং খুবই গরম তাপমাত্রার অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত। যেহেতু ওয়াটার কুলিং সিস্টেম কম তাপমাত্রা এলাকা কিংবা বেশী তাপমাত্রা যেমন মরুভূমি অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত নয় সেক্ষেত্রে এর বিকল্প ব্যবস্থা হল ওয়েল কুলিং সিস্টেম।
এগুলো ছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়। সেগুলো হলঃ
- এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনের শব্দ লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিনের থেকে বেশী।
- কমিউটার,ক্রূজার সেগমেন্ট বাইক গুলোতে সাধারণত এয়ার কুল্ড ইঞ্জিন দেখা যায় কারণ সেগুলো বেশিরভাগই কম আরপিএম এ চলে।
- স্পোর্টস ক্যাটাগরি বাইকগুলোতে সাধারণত লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিন দেখা যায় এবং যে বাইকগুলো খুবই খারাপ আবহাওয়াতে চলতে দেখা যায় সেগুলোতে ওয়েল কুল্ড ইঞ্জিন সিস্টেম ব্যবহার করতে দেখা যায়।
- এয়ার কুল্ড ইঞ্জিন ঝামেলাহীন এবং কোন পার্টস ভেঙ্গে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে খুব সহজেই রিপ্লেস এবং ঠিক করা যায়।
- লিকুয়িড কুল্ড এবং অয়েল কুল্ড ইঞ্জিনের থেকে এয়ার কুল্ড দামে বেশ সস্তা।
- এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনের থেকে লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিন বেশ টেকসই এর কারণ হল লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিনের গঠন বেশ মজবুত।
- এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনের মেইনটেনেন্স খরচ কম অন্যদিকে লিকুয়িড কুল্ড এবং ওয়েল কুল্ড ইঞ্জিনের মেইন্টেনেন্স খরচ বেশী।
কোনটা বেশি ভাল এবং কেন ?
দুটির মধ্যে যে কোন একটি পছন্দ করা একটি বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মতো। এটি সাধারণত নির্ভর করে আপনি কোন ধরনের কুলিং সিস্টেম সমৃদ্ধ বাইক কিনবেন সেটার উপর।সাধারনত কম সিসির বাইকগুলোতে এয়ার কুলিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয় তাই যারা কম সিসির বাইক কিনতে চান তাদেরকে এয়ার কুল্ড সিস্টেমে যেতে হবে কিন্তু যারা হাই সিসি হাই পারফরমেন্স এবং বেশি আরপিএম এ বাইক চালাতে চান তাদের জন্য লিকুয়িড কুল্ড ইঞ্জিন প্রয়োজন।তাই প্রস্তুতকারকের গবেষণার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে এয়ার কুল্ড এবং লিকুয়িড কুল্ড এই দুটি সিস্টেমই মোটরসাইকেলের জন্য বেশ ভাল। অন্যদিকে অয়েল কুল্ড সিস্টেমটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন কন্ডিশনে ব্যবহৃত হয়ে যার ফলে এটি আমাদের দেশের জন্য তেমন একটা উপযোগী নয়। কিন্তু প্রস্তুতকারক কোম্পানীরা বাইকের ফিচার, এলাকা, রোড কন্ডিশনের উপর ভিত্তি করেই তারা তাদের বাইকের সাথে বিভিন্ন কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করছে। এই রকম কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুতকারকেরা বিভিন্ন প্রকার গবেষণা করেছে এবং পরিশেষে তারা বিভিন্ন বাইকের সাথে উপযুক্ত কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করেছে।
আমরা আমাদের এই আর্টিকেলে প্রথমেই উল্লেখ করেছি যে লিকুয়িড কুল্ড সিস্টেম সেসকল ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয় যেসকল ইঞ্জিনের কম্প্রেশন রেশিও অনেক বেশী। যখন ইঞ্জিনে অনেক বেশি কমপ্রেশন রেশিও থাকে তখন সেই ইঞ্জিন হাই আরপিএম এ চলতে সক্ষম কিন্তু এয়ার কুল্ড সিস্টেম ইঞ্জিনে কমপ্রেশন কম হওয়ায় হাই পারফরমেন্স ইঞ্জিনের জন্য উপযুক্ত না। তাই বেশিরভাগ হাই পারফরমেন্স ইঞ্জিগুলোতে লিকুয়িড কুল্ড সিস্টেম ব্যবহৃত হয় এবং এটা নিশ্চিত যে লিকুয়িড কুলিং সিস্টেম ইঞ্জিনের মেইনটেনেন্স খরচ অনেক বেশী তবে এটা এয়ার কুল্ড সিস্টেমের থেকে বেশি টেকসই। কিন্তু এটা ভাবা যাবে না যে লিকুয়িড কুল্ড সিস্টেম ইঞ্জিনগুলো হাইয়ার পারফরমেন্স ইঞ্জিন অথবা খুব ভাল পারফরমেন্স এটা ভেবে থাকলে আপনার সময় এবং অর্থ দুটোই বৃথা যাবে। এটা শুধুমাত্র ইঞ্জিন ঠান্ডা করার একটি পদ্ধতি মাত্র এর বেশি আর কিছু নেই। ভালভাবে প্রতিদিন যত্ন নেওয়া, সময়মত লিকুয়িড পরিবর্তন করা ইত্যাদির মাধ্যমে ইঞ্জিনের পারফরমেন্স ভাল করা যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিকুয়িড কুলিং সিস্টেম এর পরিবর্তে ওয়েল কুল্ড সিস্টেম ব্যবহার করতে দেখা যায় কিন্তু ওয়েল কুল্ড সিস্টেম লিকুয়িড কুলিং সিস্টেমের মতো ওতটা সক্ষম নয়।কিন্তু আমাদের মত দেশে যেখানে ১৫০ বা ২০০ সিসির বাইক চলতে দেখা যায় সেগুলোতে বেশীরভাগই ওয়েল কুল্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয় এবং এটা এয়ার কুল্ড সিস্টেমের থেকে বেশ ভাল। অয়েল কুল্ড ইঞ্জিনে কুলেন্ট হিসেবে ইঞ্জিন ওয়েল ব্যবহার করা হয় এটি ভেতরের গরমকে খুব তাড়াতাড়ি বাইরে বের করে দিতে সাহায্য করে। গরম ইঞ্জিন এই ওয়েল এর মধ্যে তাপমাত্রা ছেড়ে দেয় এবং অয়েল হিট এক্সচেঞ্জার হিসেবে কাজ করে যেটা একটা রেডিয়েটর এর মত কিন্তু অয়েল কুল্ড হিসেবে পরিচিত।
শেষ কথা
সবকিছু তুলনা করে এবং তাদের পারফরমেন্সের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে হাই পারফরমেন্স বাইকের ইঞ্জিনগুলোতে লিকুয়িড কুলিং সিস্টেম বেশী প্রেফার করা হয়। অন্যদিকে এয়ার কুল্ড সিস্টেম খারাপ পারফরমেন্স দেয় না কিংবা এই সিস্টেম একেবারেই অকেজো না। এয়ার কুল্ড সিস্টেম সেসব বাইকে ভাল পারফরমেন্স দিয়ে থাকে যেসব বাইকের কমপ্রেশন রেশিও এবং আরপিএম পাওয়ার কম। এখন আপনি কোন ধরনের ইঞ্জিন সিস্টেম পছন্দ করে নিবেন এটা সম্পূর্ণ আপনার রাইডিং করার উপর নির্ভরশীল। রাইডিং কন্ডিশনের উপর বিবেচনা করে এয়ার কুল্ড সিস্টেম ভাল পারফরমেন্স দিতে পারে। কিন্তু স্পোর্টস ক্যাটাগরি বাইক বা অন্য কোন হাই পারফরমেন্স ইঞ্জিনের কম্প্রেশনের জন্য লিকুয়িড কুল্ড সিস্টেম ভাল।