ইন্ট্রো:
ইয়ামাহার নাম শুনলেই আমাদের মস্তিষ্কে স্পোর্টি লুকের ড্যাশিং বাইকের চিত্র ভেসে ওঠে। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন, পৃথিবীর অনেক মানুষই ইয়ামাহাকে চেনে একটি মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হিসেবে। তাদের অনেকেও হয়তো জানেইনা ইয়ামাহার মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রির সম্পর্কে।
প্রায় অর্ধ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে ইয়ামাহা একইসাথে দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে দাপটের সাথে বিজনেস করে আসছে। এটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র শুরু থেকেই ইয়ামাহার ওয়ার্ল্ড ক্লাস প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচার করার স্পিরিট থেকে।
ইয়ামাহার রয়েছে বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। তো চলুন জেনে নিই, ইয়ামাহার ইতিহাস সম্পর্কে।
ইয়ামাহার ইতিহাস:
মিউজিক এবং মোটরসাইকেলের এই দ্বৈত বিজনেস স্ট্রাটেজির জন্য ইয়ামাহার ইতিহাসকে দুইটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করতে হবে। যথা:
১. ইয়ামাহা কর্পোরেশন
২. ইয়ামাহা মোটরস
ইয়ামাহা কর্পোরেশন :
ইয়ামাহা নামটিই মূলত এসেছে এর প্রতিষ্ঠাতা Torakusu Yamaha থেকে। তিনি ছিলেন একজন reed organ manufacturer এবং watchmaker। মি. ইয়ামাহা জাপানের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতেন। সেখানে একবার হাসপাতালে একটি সাউন্ড অর্গানের প্রয়োজন ছিলো চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ঐখানে এই কাজের জন্য কোন টেকনিশিয়ান ছিলোনা। তখন তারা মি. ইয়ামাহাকে কাজটি করতে অনুরোধ করেন। ইয়ামাহা চারমাস কঠোর পরিশ্রমের পর পারফেক্ট টিউনের অর্গান তৈরি করতে সক্ষম হন এবং কথিত আছে যানবাহন না পাওয়ায় এই অর্গানটি মি. ইয়ামাহা নিজ কাঁধে করে একটি পাহাড় অতিক্রম করে হাসপাতালে দিয়ে আসেন।
মি. ইয়ামাহার ভালো প্রোডাক্ট তৈরীর প্রতি এই ডেডিকেশন পরবর্তীতে তাকে জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কোম্পানি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো।
এই অর্গানটি তৈরির পর তিনি মিউজিকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি খেয়াল করেন তার প্রোডাক্টটিকে তিনি আরেকটু টিউনিং করে মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবেই বাজারজাতকরণ করতে পারবেন। ১৯০০ সালের দিকে ইয়ামাহাই সর্বপ্রথম জাপানে পিয়ানো তৈরি করেন। এরপর ১৯৪০ এর দিকে জাপানে সঙ্গীত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলস্বরুপ ইয়ামাহার মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট বিক্রির পরিমাণও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এভাবেই ইয়ামাহা কর্পোরেশন যাত্রা শুরু করে।
আজকের দিনে ইয়ামাহা কর্পোরেশন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী তাদের রেভিনিউ ছিলো প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার।
ইয়ামাহা মোটরস:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপানকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করে দেয়।সেসময় ইয়ামাহা জাপানের জন্য এয়ারক্রাফট প্রপেলার তৈরি করতো। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হারের ফলে ইয়ামাহাও বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তারপর ইয়ামাহা তাদের এয়ার ক্রাফট প্রপেলার নির্মাণের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সাধারণ যানবাহনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়ামাহা মোটরস ১৯৫৫ সালে ইয়ামাহা কর্পোরেশন থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
ইয়ামাহার প্রথম মটোরসাইকেল:
মোটরচালিত যানবাহনের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে ১৯৫৫ সালের দিকে মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে মনোনিবেশ করে। সেসময় জাপানের মার্কেটে ইতিমধ্যেই ২০০ টিরও বেশি মোটরসাইকেল কোম্পানি ছিলো। ইয়ামাহাই তুলনামূলক দেরীতে তাদের যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রথম মোটরসাইকেল ছিলো Yamha YA-1 (125cc, 2-stroke, single-cylinder, street bike) যার নিকনেম ছিলো “The Red Dragonfly। ইয়ামাহার প্রথম বাইকটিই একটি মাস্টারক্লাস প্রোডাক্ট হিসেবে বাজারে বিবেচিত হয়। প্রথমদিকে এটি শুধুমাত্র জাপানেই বিক্রি করা হতো। ইয়ামাহার তৈরিকৃত এই মোটরসাইকেলটি তাদের প্রথম দুই রেসের দুটিতেই জয়লাভ করে ইন্ডাস্ট্রিতে শোরগোল সৃষ্টি করে দেয়।
১৯৫৫-২০০০ সালে ইয়ামাহা:
ইয়ামাহা YA-1 নিজের প্রথম রেসেই জাপানের সবচেয়ে বড় রেস জয় ছিলো ইয়ামাহার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অতি দ্রুত চারিদিকে ইয়ামাহার নামডাক ছড়িয়ে পরে।১৯৫৮ সালের দিকে ইয়ামাহা প্রথম জাপানের বাইরে মেক্সিকোতে তাদের অফিস চালু করে।
এরপরেই আমেরিকাতে ইয়ামাহা ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন স্থাপন করা হয়।
১৯৬৩ সালের দিকে ইন্ডিয়াতে “পার্ল ইয়ামাহা”
যাত্রা শুরু করে। পরের বছরেই ইয়ামাহা World GP road race এ ২৫০ সিসিতে একইসাথে ম্যানুফ্যাকচারার এবং রাইডার হিসেবে টাইটেল জয় করে।১৯৭০ সালে তারা ব্রাজিলে এবং ১৯৭৩ সালে কানাডাতে তাদের বিজনেস শুরু করে।
ইয়ামাহা ইতিমধ্যেই মোটরসাইকেলের বাইরে YG292 নামে তাদের প্রথম গলফ কার, ET1250 নামে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবোট এবং পার্সোনাল ওয়াটারক্রাফট, গ্যাস হিপ পাম্প এবং RC100 নামে রেসিং কার্ট মডেল নিয়ে বাজারে আসে।
ইয়ামাহা তাদের প্রোডাক্টের গুণগতমানের দিকে প্রথম থেকেই ফোকাসড ছিলো। ইয়ামাহা মোটরস এর ফাউন্ডিং প্রেসিডেন্ট গেনিচি কাওয়াকামি বলেন, “it’s not a product, if it’s not world class” অর্থাৎ প্রোডাক্টটি যদি ওয়ার্ল্ড ক্লাস না হয় তবে সেটি কোন প্রোডাক্টই নয়।
একুশ শতকে ইয়ামাহা মোটরস:
এই শতকে ইয়ামাহা মোটর কর্পোরেশন (ওয়াইএমসি) বায়োটেকনোলজি এবং স্পোর্টস সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করে। ২০০৬ সালে কোম্পানিটি ইন্দোনেশিয়ায় YMMWJ প্রতিষ্ঠা করে।
২০১৩ সালে ইয়ামাহার ব্র্যান্ড স্লোগান রাখা হয় “Revs your heart “। এবছরেই কোম্পানির আউটবোর্ড মোটর উৎপাদন প্রায় দশ মিলিয়ন অতিক্রম করে। ২০১৯ সালে, ইয়ামাহা মোটর রোবোটিক্স হোল্ডিংস কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই শতকে ইয়ামাহা প্রোডাক্টের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হিসেবে কিছু সোশ্যাল রিস্পন্সিবিলিটির কাজেও সংযুক্ত হয়।
সোশ্যাল রিস্পন্সিবিলিটিতে ইয়ামাহা:
ইয়ামাহা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কথা বিবেচনা করে বরাবরই কোয়ালিটি প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ,
২০০২ সালে ইয়ামাহা ইলেকট্রিক কমিউটার Passol নিয়ে আসে যেটি স্পেশালি নারীদের জন্য ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছিলো।
আবার ইয়ামাহা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য হুইল চেয়ারও ম্যানুফ্যাকচার করে। ২০১৫ সালে তারা ইয়ামাহা মোটরস মিরাই প্রতিষ্ঠা করে যেটার উদ্দেশ্য ছিলো কর্মক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের নিয়োগ দেওয়া।
এছাড়াও ইয়ামাহা বৈশ্বিক উষ্ণতার কথা বিবেচনায় নিয়ে কার্বন নিউট্রালিটি অর্জনের জন্য ২০১৮ সালে Yamaha Motor Group Environmental Plan 2050 করে। এই প্ল্যানের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০% কার্বন ইমিশন কমানো।
বর্তমান অবস্থা:
ইয়ামাহা মোটরস সেলস এবং রেভিনিউ এর হিসাব বিবেচনায় বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মোটরসাইকেল একটি কোম্পানি। বর্তমানে বিশ্বের ২০০ টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চলে ইয়ামাহা অপারেট করে। ১৯৬১ সালে ইউরোপে ঢোকার পর এখন ইউরোপের ৪০ টিরও বেশী দেশে গৌরবের সাথে বিজনেস করছে ইয়ামাহা।
ইয়ামাহা ফ্যাক্টবুকের হিসাব অনুসারে ইয়ামাহা মোটরস এর বর্তমান ক্যাপিটাল প্রায় 782.73 million USD।
বর্তমানে এই কোম্পানির অধীনে প্রায় ৫২ হাজার কর্মচারী রয়েছে। ইয়ামাহার অধীনে সাবসিডিয়ারি আছে প্রায় ২৭ টি।
গতবছরে বিশ্বজুড়ে মোটরসাইকেলের চাহিদা ছিলো ৪৯.৫ মিলিয়ন। শুধু ইয়ামাহাই এই চাহিদার প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ১০% একাই পূরণ করেছে। এই ৪.৭ মিলিয়নের মধ্যে আবার ৮২% ই এশিয়ায় বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশের চিত্র দেখলেই বিষয়টি আরোও পরিষ্কার হবে।
বাংলাদেশে জাপানিজ, ইন্ডিয়ান, চাইনিজ এবং দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভালো কোয়ালিটির মোটরসাইকেল বাজারে রয়েছে। এতো ব্যাপক প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও ১৫০ সিসির মতো কম্পিটিটিভ সেগমেন্টে রাইডারদের প্রথম চয়েস ইয়ামাহা। ২০২২ সালে ১৫০ সিসি সেগমেন্টে বাংলাদেশে আনুমানিক আড়াই লাখের বেশি ইউনিট মোটরসাইকেল সেল হয়। এর মাঝে প্রায় ২৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ারই ছিলো ইয়ামাহার দখলে।
একসময় মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচার হিসেবে শুরু করা এই কোম্পানিটি আজ motorcycles, scooters, electrically power-assisted bicycles, boats, sailboats, personal watercraft,
Pools, utility boats, fishing boats, outboard motors, all-terrain vehicles, recreational off-highway vehicles, racing kart en-
Gines, golf cars, multi-purpose engines, generators, water pumps, snowmobiles, small snow blowers, automobile engines,
Surface mounters, intelligent machinery, semiconductor manufacturing equipment, industrial-use unmanned aircraft, elec-
Tric wheelchairs, helmets সহ আরোও অসংখ্য প্রোডাক্ট তৈরী করছে। এবং এদের প্রত্যেকটি প্রোডাক্টই নিজ নিজ ফিল্ডে মার্কেট লিডিং পজিশনে অবস্থান করছে।