সারাবিশ্বের বহুল ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিগত বাহনগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল অন্যতম যা ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে কমবেশি সবারই পছন্দ তালিকাত শীর্ষেই থাকে। ২ চাকার এই বাহনটি কিছু মানুষ প্রয়োজনে, কিছু মানুষ শুধু শখের জন্য কিংবা অনেকে উভয় কাজে ব্যবহার করেন। এই প্রিয় বাহনটির জন্যেও তাই অনেকেই প্রচুর অর্থ খরচ করতে পিছপা হন না বিশেষত যারা সখের বসে বাইক কিনেন। তবে বাইক প্রেমী বা ব্যবহারকারী সকলের মনেই একটা প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক যে একটি দুই চাকার বাহন অর্থাৎ একটি মোটরসাইকেল ঠিক কতটা দামী হতে পারে বা বিশ্বের সবচেয়ে দামী বাইকগুলো দেখতে কেমন বা দাম কত?
চলুন দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে দামী এবং ব্যয়বহুল কয়েকটি মোটরসাইকেল সম্পর্কে এবং সেগুলো কেন এত ব্যয়বহুল এবং কোন কোন বৈশিষ্ঠ্য সেই বাইকগুলিকে এত অনন্য করে তুলেছে।
Neiman Marcus Limited Edition Fighter
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি মোটরসাইকেল হলো নেইমান মার্কাস লিমিটেড এডিশন ফাইটার। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১১৭ কোটি টাকা।
Neiman Marcus Limited Edition Fighter বাইকটিতে রয়েছে ১২০সিআই ৪৫টুইন ইঞ্জিন সাথে টাইনিয়াম- এয়ার কুলড ভি-ডিগ্রি অ্যালুমিনিয়াম এবং কার্বন ফাইবার বডি পার্টস। মোটরসাইকেলের ফ্রেমটি কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি বলে এটি অসম্ভব শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ওজনে অত্যন্ত হালকা। যা খুব দ্রুত এর গতি বাড়াতে সাহায্য করে। এই সীমিত সংস্করণের মোটরসাইকেলটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৯০ মাইল বা ৩০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে।
এর অনন্য ডিজাইন এবং পারফরম্যান্স বাইকটিকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মোটরসাইকেলগুলোর মধ্যে একটির মধ্যে স্থান করে দিয়েছে।
1949 E90 AJS Porcupine
ই৯০ এজিএস পোর্কুপাইন ১৯৪৯ সালের মোটরসাইকেল হওয়া সত্বেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে দামি মোটরসাইকেলের তালিকায় স্থান দখন করে আছে। ১৯৪৯ সালে মোটরসাইকেলটির মাত্র ৪টি মডেলে তৈরি হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে রেসার “লেস গ্রাহাম” সেগুলোর মধ্যে একটিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। এই ক্লাসিক ভিনটেজ মোটরসাইকেলটির মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ার পেছনে এটি অন্যতম একটি কারণ।
Ecosse ES1 Spirit
ECOSSE ES1 Spirit এর ডিজাইন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এই বাইক ব্রান্ডটিকে একটি শিল্পে পরিনত করেছে। ৩৬ লাখ মার্কিন ডলারের এই মোটরসাইকেলটি টাইটেনিয়াম ফ্রেমে তৈরি, যা একে মজবুত করার পাশাপাশি ওজনেও অনেক হালকা করে তুলেছে। ১২০ কেজির মোটরসাইকেলটিতে রয়েছে একটি বিরল V4, 4- Stroke ইঞ্জিন। যা একে প্রতি ঘন্টায় ২৪০ মাইল বা ৩৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলতে সাহায্য করে।
ECOSSE ES1 Spirit বাইকটির এই বিশেষত্বের কারণে, যারা এই দুর্দান্ত মোটরসাইকেলটি চালাতে চান তাদের প্রথমে প্রস্তুতকারকের থেকে ২ সপ্তাহের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এইদিক বিবেচনায় বলা যায় যে এই বাইকটা একন্তই সৌখিন বাইকার না হলে কেউই কিনতে না চালানোর মত ঝুকি নিতে চাইবেন না।
Hildebrand & Wolfmüller
সবচেয়ে দামী বাইকের তালিকায় নামটি দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন যে এই বাইকটিতে মনে এমন কিছু ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়েছে যার কারনে এর মুল্যমান সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেছে কিন্তু আসল রহস্যটা হলো, ১৮৮৪ সালে যখন ঘোড়ার প্রচলন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল তখন হেনরিক, উইলহেলম এবং অ্যালোইস উলফমুলার এই মোটরবাইকটি তৈরি করেছিলেন। Hildebrand & Wolfmüller মোটরসাইকেলে কোনো ক্ল্যাচ বা প্যাডেল নেই, যা খুবই আশ্চর্যজনক। তার থেকেও মজার বিষয় হলো একে স্টার্ট করার জন্য চলা অবস্থায় ধাক্কা দিতে হয় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো বাইকটা স্টার্ট হওয়ার পর লাফ দিয়ে মোটরসাইকেলটিতে উঠতে হয়।
এখানে দামের ব্যাপারটা উল্লেখ করতে গেলে বলতে হবে, শুধুমাত্র অ্যান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা করে Hildebrand & Wolfmüller মোটরসাইকেলটির মূল্য ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে। অ্যান্টিক কারণে ২০২৩ সালে এসেও বিশ্বের সবচেয়ে দামি মোটরসাইকেলের তালিকায় এটি স্থান করে নিতে পেরেছে।
BMS Nemesis
২০০৬ সালে ডেটোনা বিচের র্যাটস হোল শো-তে প্রথম পুরষ্কার গ্রহন করে বিএমএস নেমেসিস মোটরসাইকেলটি। ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের এই মোটরসাইকেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ২৪-ক্যারেটের স্বর্ন। BMS Nemesis এর ডিজাইন এবং বাইকের ভেতরের বাইরের সবকিছুই অত্যন্ত বিলাশবহুল এবং চমকপ্রদ।
Harley-Davidson Cosmic Starship
Harley-Davidson এমনিতেই সারাবিশ্বে একটি নামকরা মোটরসাইকেল ব্রান্ড সেখানে Harley-Davidson Cosmic Starship হলো যন্ত্রের সঙ্গে শিল্পের দারুন একটি সংমিশ্রন। কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী জ্যাক আর্মস্ট্রং এটির নকশা তৈরি করেন। যদিও Harley-Davidson Cosmic Starship স্ট্যান্ডার্ড বৈশিষ্ট্যগুলো বর্তমানের অনেক পাওয়ার বাইকের কাছাকাছিও আসে না। তবে জ্যাকের ডিজাইন করা এই বিরল প্রযুক্তিগত শিল্পটি ২০২৩ সালে এসেও এক অসাধারন আইকনিক মাস্টারপিসে রূপান্তরিত হয়েছে।
এক পর্যায়ে এই মোটরসাইকেলটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারেও বিক্রি হয়েছিল এবং বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি বাইকও ছিল। তবে বর্তমানে এর দাম কিছুটা কমার পরও সবচেয়ে মূল্যবান মোটরসাইকেলের তালিকায় এখনও স্থান করে নিতে পেরেছে।
Dodge Tomahawk V10 Superbike
২০০৩ সালে সীমিত সংস্করণের মোটরবাইক হিসেবে মাত্র ৯টি ডজ টমহক ভি১০ সুপারবাইক বিক্রির জন্য রিলিজ দেওয়া হয়। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বের দ্রুততম বাইকগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে রয়ে গেছে। যার সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৪০০ মাইল পর্যন্ত এবং এটি ঘণ্টায় মাত্র ২ দশমিক ৫ সেকেন্ডে ৬০ মাইল পর্যন্ত গতি তুলতে পারে। তবে বাইকটি আমাদের দেখা সাধারন বাইকের থেকে অনেক বেশি ভারী, এর ওজন ৬৮০ কেজি।
এ ছাড়া এতে রয়েছে একটি V10 4-Stroke ডজ ভাইপার ইঞ্জিন যা এর সামগ্রিক পারফরমেন্সকে অনন্য এক লেভেলে নিয়ে গেছে। ২০০৩ সালে এর দাম ছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। Dodge Tomahawk V10 Superbike মোটরসাইকেলটি আজও বিশ্বের দ্রুততম মোটরসাইকেলগুলোর মধ্যে একটির জায়গা দখল করে রেখেছে।
Legendary British Vintage Black
১৯৪৮ সালে যখন এটি যুক্তরাজ্যে প্রথম উৎপাদিত হয়েছিল, তখন এটি প্রাথমিকভাবে ভিনসেন্ট-এইচআরডি নামে পরিচিত ছিল। আর সেই সময়ে এটি ছিল বিশ্বের দ্রুততম মোটরসাইকেল। তৎকালীন সময়ে শ্বাসরুদ্ধকর নকশার এই মোটরসাইকেলের মাত্র ৩৩টি ইউনিট তৈরি করা হয়। এই মোটরসাইকেলের উৎপাদন বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও আজও Legendary British Vintage Black একটি আইকনিক আইটেম হয়ে আছে। যা এখনো অনেক সংগ্রাহকদের পছন্দের শীর্ষে বিশেষত যারা ওল্ড ক্ল্যাসিক ডিজাইন পছন্দ করে কিন্তু কেউ যদি এখন এটি কিনতে চান, তবে তাকে ব্যয় করতে হবে ৪ লাখ মার্কিন ডলার।
Ecosse FE Ti XX Titanium Series
ইকোসের এই মডেলটিকে বলা হয় প্রযুক্তিগত বিস্ময়। যা ২০০৭ সালে একটি সীমিত সংস্করণের মোটরবাইক হিসেবে উৎপাদিত হয়। এর বিক্রয়ের জন্য রয়েছে মাত্র ১৩টি ইউনিট। এটি সম্পূর্ণরূপে কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। এতে রয়েছে একটি ২ দশমিক ৪ লিটার বিলেট অ্যালুমিনিয়াম ইঞ্জিন যা ২২৮ হর্সপাওয়ার তৈরি করতে সক্ষম।
হালকা আকার এবং নান্দনিকতার সমন্বয় একে দিয়েছে তাকিয়ে থেকে দেখার মতো সৌন্দর্য্য। এ কারণে মূল্য ৩ লাখ মার্কিন ডলার এবং এত দাম হউয়ার পরেও যারা এই বাইকটিকে ভালভাবে জানে তারা কোনভাবেই এই দামে অবাক হন না।
Ducati DESMSDC D16RR NCR M16
২০০৭ সালে বিশ্ববাজারে আসার মাধ্যমে ডুকাটির প্রযুক্তিগত বিবর্তনের একটি নতুন সীমানা উন্মোচন করে এই মোটরসাইকেলটি। টাইটানিয়াম, এভিওনিক, অ্যালুমিনিয়াম এবং কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি মোটরসাইকেলটি। এতে রয়েছে একটি ফোর স্ট্রোক ভি৪ ইঞ্জিন, একটি ইঞ্জেকশন ফুয়েল সিস্টেম এবং একটি ৬ স্পীডের গিয়ারবক্স।
Ducati DESMSDC D16RR NCR M16 মোটরসাইকেলটি মূলত রেসিংয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে বর্তমানে এই বাইকটির বাজার মূল্য ২ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।
মোটরসাইকেলগুলোর এত দামের কারণ নিয়ে বলতে গেলে শুরতেই বলতে হবে যে,বিভিন্ন কারণে এই মোটরসাইকেলগুলো এত ব্যয়বহুল হয়ে থাকে।
প্রথমত, বলা যায় এদের এক্সক্লুসিভিটি। দামি মোটরসাইকেলগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় তাদের উৎপাদনের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। যা তাদের মূল্য বৃদ্ধি করে আরও বেশি এক্সক্লুসিভ করে তুলেছে। যার কারণে সেগুলো অনেক সংগ্রাহক এবং মোটরসাইকেলপ্রিয় মানুষের কাছে অত্যন্ত পছন্দের হয়ে উঠে। যা তাদের মূল্য বৃদ্ধিতে আরও বেশি ভূমিকা রেখেছে।
তারপর রয়েছে এদের গুণমাণ। এই মোটরসাইকেলগুলো প্রায়শই অত্যন্ত উচ্চ মানের সামগ্রী এবং উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। যা তাদের বাজারের সেরা এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাইক হিসেবে স্থান করে দিয়েছে। কার্বন ফাইবার, টাইটানিয়াম এবং অন্যান্য উচ্চমানের উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে মোটরসাইকেলগুলো অবিশ্বাস্যভাবে টেকসই ও মজবুত।
এ ছাড়া এদের সামগ্রিক পারফরম্যান্স; বিশেষ করে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা হয় দেখার মতো। এই মোটরসাইকেলগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উন্নত মানের ইঞ্জিন ব্যবহার করে। যেগুলো এই মোটরসাইকেলগুলোকে করে তোলে অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতির। যা এদের মূল্যবৃদ্ধির পেছনের আরেক কারণ।
অন্যদিকে রয়েছে ব্র্যান্ডের খ্যাতি। যে ব্র্যান্ডগুলো এই দামি মোটরসাইকেলগুলো তৈরি করে, তাদের এরকম উচ্চ মানের এবং উচ্চ কর্মক্ষমতা সম্পন্ন বাইক তৈরির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই ব্র্যান্ডগুলোর খ্যাতি অনেক সময়ই মোটরসাইকেলের উচ্চমূল্যের কারণ।
এ ছাড়া রয়েছে এসব ব্র্যান্ড থেকে দেওয়া বিশেষ কিছু সুবিধা। যার মধ্যে রয়েছে ক্রেতার প্রয়োজন অনুসারে কাস্টমাইজেশন করার সুযোগ। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী মোটরসাইকেলে কাস্টম পেইন্ট জব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্টস এবং ক্রেতার সুবিধামত আনুষাঙ্গিক অনেক কাস্টমাইজেশনের সুবিধা।
কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে, নান্দনিকতা থেকে পারফরম্যান্স পর্যন্ত; সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ে মোটরসাইকেলগুলো এত ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। তবে বাজার পরিস্থিতি এবং মোটরসাইকেলের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এসব দাম বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়ে থাকে।