বাইকের প্রতি ভালবাসা যেমন থাকে সবার ছোটবেলা থেকেই ঠিক ততটাই উল্টা আমার বাইকের প্রতি ভালবাসার সময়কালটা। বাইক প্রথম নিজে চালালাম এস এস সি পাশের পর তাও হটাত করে ইচ্ছা হল সেই কারণে।তবে ওই সামান্য ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত যে আমাকে একজন বাইকার করে গড়ে তুলবে তা কখনই ভাবি নি এবং আমি নিজেও চাই নি। পরবর্তীতে একটা সময় মনে হল আমার একটা বাইক নিজের থাকার দরকার। মন স্থির করলাম একটা বাইক আমার লাগবেই এবং ওই স্বপ্নের বাইক হতে হবে ইয়ামাহা এফ জেড এস।কেন এত বাইক থাকতে ইয়ামাহা এফ জেড এস আমার লাগবেই এটার উওর আজ ও জানা নেই আমার।আমি স্টুডেন্ট এবং বাপ মায়ের এক মাত্র ছেলে বলে তাদেরকে বাইক কেনার ব্যাপারে রাজি করানোর প্রতিটা মুহূর্ত ছিল আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।তবে আমার আচরণ ছিল না হুমকি/জিম্মি করা টাইপ বাবার প্রতি।২০১৫ সালের শেষের দিক এইচ এস সি পাশ করলাম।বাসায় ও রাজি কিন্তু বাঁধ সাধল ওই সময় পুরা ঢাকাতে কোন ডিলারের কাছে কোন বাইক নাই।কর্ণফুলি তখন পুরোপুরি বাইক আনা বন্ধ করে দিছে।বাজারে তখন অন্য বাইকের ছড়াছড়ি।কিন্তু আমার তো এফজি লাগবেই। টানা ১ মাস খুঁজলাম মিরপুর-ইস্কাটন-কাক্রাইল-বংশাল ।কোথাও পেলাম না পুরানো কিছু বাইক পেলাম তাও দাম যা চাই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এক সময় আশা ছেড়ে দিলাম এবং মন স্থির করলাম বাইক কিনলে এফজি কিনবই তবে সময় লাগুক সমস্যা নেই।একটা সময় ভুলে গেলাম বাইকের কথা।নর্থ সাউথে এডমিশন নিলাম তখন যাতায়াতের জন্য বাইক যে আমার দরকার তা আবার মনে হল।এভাবে কেটে গেল ১ টা বছর। এসিয়াই ভি২ এফজি ফেজার আনা শুরু করল বিডিতে আমার মন একটু হলেও আনমনে আবার বাইকের আশায় স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করল।আবার বাসায় বললাম আবার রাজি করালাম।বাইক হাতে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটা রাত ছিল এক মাসের অধিক সময়।শেষ পর্যন্ত ২০১৭ মডেল মে মাসে এসিয়াই ইমপোর্ট করল এবং আমি তার ১-২ দিন পরেই অর্থাৎ মে মাসের ৪ তারিখ বাইক কিনলাম। “এফ জেড এস এফাই ভি ২ –হারিকেন গ্রে “ আমার জীবনের প্রথম বাইক এবং পথচলা শুরু বাইকিং জীবনের তখন থেকেই।আমার কাছে শুধু একটা বাইক না একটা ভালবাসা একটা মায়ার নাম। আজ ১ বছর ৫ দিন হতে চলল আমার বাইকের বয়স। অলরেডি ১০০০০ কিমি অতিক্রম করলাম এফজি এফাই দিয়ে। তাই আজ একটু রিভিও লিখতে বসলাম ।হইত ১জন মানুষের উপকার হলেও হবে এই তাগিদা থেকে।তাহলে শুরু করি এই ১০০০০ কিমি পথচলা আমার বাইকের সাতকাহন-
এক্সলারেশন - এক্সলারেশন আমার কাছে যথেষ্ট স্মুথ মনে হয়েছে। “র” পাওয়ার এই ১৫০ সিসি সেগমেন্টের অন্য বাইক থেকে কম তবে ০-১০০ স্পিড পর্যন্ত খুব ইজিলি উঠানো যায়। তবে বর্তমানে লেজার ইরিডিয়াম ব্যবহার করছি। যা টপ বাড়াবে না তবে হাই রেভে ভাইব্রেশন অনেক খানি কমিয়ে দিয়েছে এবং এক্সলারেশন আরও দ্রুত ও স্মুথ পাচ্ছি।যা হাইওয়েতে ওভার ট্যাকিং এর সময় কনফিডেন্স বাড়িয়ে দেই।
ব্রেকিং, ব্যালেন্স ও কন্ট্রোলিং -ডিস্ক ও ড্রাম এই দুইয়ের সম্বনয়ে এর ব্রেকিং সিস্টেম হয়ে উঠেছে অসাধারণ। নিঃসন্দেহে এই বাইকের ব্যালেন্স ও কন্ট্রোলিং ১৫০ সিসি সেগমেন্টে যত বাইক আছে তার মধ্যে বেস্ট।চাকা মোটা হওয়ার কারণে বালি কাঁদাতে সহজে স্কিড করে না।অনেক খারাপ খারাপ সিচুয়েশন এর অসাধারণ ব্রেকিং ও কন্ট্রোলিং এবং আপনাদের ভালবাসার কারণে বেঁচে ফিরে আজ এই রিভিও লেখতে পারছি।আমার মনে হয় এত দাম দিয়ে এই বাইক চয়েজের অন্যতম একটা কারণ এর অসাধারণ ব্রেকিং ও নৈপুণিক ব্যালেন্স ।
সিটিং পজিশন- পারফেক্ট সিটিং পজিশন বলতে যা বুঝায় টা আপনি এই বাইকে পাবেন।পিলিওন সিট বড় ও আলাদা হওয়ার কারণে পিলিওনের চাপ ক্যারি করা লাগে না রাইডারের।
সাসপেনশন - এত স্মুথ ও নরম এর মনোশক সাস্পেনশন যা আমি অন্য বাইকে কখনই পায়নি। ভাঙা চুরা রোডে এর মনো সাস্পেনশন ও ফ্রন্ট ফ্রক এর আসল রূপ পাওয়া যায় ।ইজিলি এব্জরভ করে ফেলে বলে ভোগান্তিতে পরতে হয়নি কখনই গর্তে পড়ে।একটানা অনেক সময় চালালেও কষ্ট ও হাত পা মাজা ব্যাথা হয় না।
মাইলেজ - প্রথম থেকেই আমি ৪২-৪৫ কিলোমিটার /লিটার পাচ্ছি।হাইওয়ে তে আমি প্রতিবার পাই মিনিমাম ৫৫-৫৭কিলোমিটার লিটার প্রতি।(এইটা নিয়ে কন্ট্রোভার্সি হতে পারে তাই আপনার ভাল না লাগলে এভয়েড করে যেতে পারেন।তবে কেউ চ্যালেঞ্জ দিলে আমি প্রস্তুত)।
ইঞ্জিন ওয়েল - আমার মত নতুন বাইকারদের প্রথম প্রশ্নই থাকে ভাই কি ইঞ্জিন ওয়েল ইউজ করব।তবে আমার এই লিখা হইত আপনারা পড়ার পর একটা এন্সার পাবেন।প্রথম দুই হাজার কিমি আমি ৪ টা ইয়ামালুব চালিয়েছি।প্রতি ৫০০ কিমি পর পর ড্রেইন দিতাম।তবে মন মত পারফর্মেন্স পাই নি দেখে ২০০০ কিমি এর পর মতুল মিনারেল ২০W৪০ ব্যবহার করেছি।আমি মতুল মিনারেল দিয়ে ৮০০০ কিমি রাইড করেছি।প্রথম দিকে ৬০০ কিমি চালিয়েছিলাম মতুল মিনারেল। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে ১০০০ কিমি পর্যন্ত চালাতাম মিনারেল দিয়ে।মতুল মিনারেল এর সাতকাহন আপনারা আগেই পড়েছেন অনেকে হইত আমার পোস্টে তবে কেউ চাইলে আমি আবার লিংক দিব দেখে নিতে পারেন।সবাই হইত অবাক হচ্ছে আমি কেন সিথেটিক ইউজ করি নাই এতদিন।আসলে ওরকম কোন কারণ নেই তবে ৮০০০ কিমি এর পর আমি সিনথেটিক ইঞ্জিল ওয়েল প্রথম বাইকে দেই এবং টা জিক এম৯।এখন ও ড্রেইন দেই নাই। যেহেতু প্রথম সিনথেটিক এবং ২টা ইউজ না করা পর্যন্ত প্রপার পারফর্মেন্স পাওয়া পসিবল না তাই এই নিয়ে বিস্তারিত বলব না এখনি।তবে আমি এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট।তবে প্রতিবার আমি ইঞ্জিন ওয়েল ড্রেইনের সময় নিউ ওয়েল ফিল্টার লাগিয়ে নেই।
হেডলাইট - এর স্টক হেডলাইট বাল্ব খুব দুর্বল ।এই স্টকের আলো নিয়ে হাইওয়ে তে রাইড করা খুব কষ্টকর যারা আমার মত ৪ চোখের অধিকারী আরকি।তাই আমি প্রথম থেকেই ওরিজিনাল মটোলেড ব্যবহার করছি এবং হাঈওয়ে তে এক্সটা সাপোর্ট এর জন্য একজোড়া ফগ লাইট লাগিয়ে নিয়েছি।
সাউন্ড ইস্যু - সবার মুখে মুখে একটাই কথা সাউন্ড নষ্ট হয়ে যায় কিছুদিন পর পর।তবে আমার এখন পর্যন্ত সাউন্ড ইস্যু নিয়ে কোন ঝামেলা হয় নি।একদম মাক্ষন সাউন্ড।ইঞ্জিন হেড খুলা ও ট্যাপেট মিলানোর প্রয়োজন হয়নি এখন পর্যন্ত।
টপ স্পীড - আমি সিটি/হাইওয়ে তে সিচুয়েশন বুঝে হাই লো উভয় রেভেই বাইক চালাই।যদি ও আমি টপে বিশ্বাসী না তবে টপ পেয়েছি ১১৬ সম্পূর্ণ স্টক জিনিস নিয়ে।আরও সুযোগ ছিল তবে একটা কারণে আর হয় নি। তবে অনায়েশে ১২০ পাওয়া যাবে।
টেইল লাইট ও ইনডিকেটর লাইট - যে কেউ এর টেইল লাইট দেখে মুগ্ধ হবে।টেইল লাইট ও ইনডিকেটর লাইট যথেষ্ট মজবুত এবং এখন পর্যন্ত কোন বাল্ব কেটে যায় নি ।
চেইন - আমার বাইক ১৭ মডেলের প্রথম লটের।তাই আমি নরমাল চেইন পেয়েছিলাম। যদি ও চেইন নিয়ে খুব একটা ঝামেলায় পরতে হয়নি আমার।তবে ৭০০০ কিমি চলাকালীন এসিয়াই আমার বাইকের চেইন চেঞ্জ করে ওরিং চেইন ইন্সটল করে দেই।এজন্য এসিয়াই কে ধন্যবাদ।
রং,কিট ও সাইড প্যানেল - মাঝে খুব প্রকট আকার ধারণ করেছিল রং উঠে যাচ্ছে ইঞ্জিন থেকে অনেকের।তবে আমার এখন পর্যন্ত কোথাও কোন রং উঠে নি।এই বাইকের আর একটা সমস্যা ছিল কিট ও সাইড প্যানেলের প্লাস্টিক ভেঙ্গে যাওয়া ।আল্লাহ্র রহমতে আমার এই সব কোন সমস্যা ফেস করা লাগে নি।আমার কাছে এর বডি ও কিট মজবুত মনে হয়েছে যথেষ্ট। যদি ও বাইক নিয়ে আমি কখনও কোথাও পোড়ে যায়নি।
মিটার বোর্ড - সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও সিম্পেলের মধ্যে দেখতে সুন্দর বলতেই হবে।তবে আমি অনুভব করি গিয়ার ইন্ডিকেটর ও ঘড়ির প্রয়োজনিয়তা মাঝে মাঝে। যা থাকলে আর ও ভাল হত।তবে ওয়েল ইন্ডিকেটর প্রপার কতটুকু তেল আছে বাইকে তা সহজে সঠিক পরিমাণ জানাতে পারবে না।
সুইচ প্যানেল ও হর্ণ - সম্পূর্ণ সুইচ প্যানেল দেখতে সুন্দর ও মজবুত। অন্য বাইকের মত প্লাস্টিক কোয়ালিটি না। স্টক হর্ণ খুব দুর্বল সিটি ও হাইওয়ে রাইডের জন্য আমার মনে হয়েছে।তয়াই আমি পি৭০ সিটির জন্য এবং ইলেকট্রিক হর্ণ রিলে লাগিয়ে ইউজ করছি হাইওয়ের জন্য।
আফটার সেলস ও সার্ভিস - এখন পর্যন্ত ৩ টা ফ্রি সার্ভিসিং করিয়েছি ক্রিসেন্ট থেকে খুব নরমাল কাজ গুলায় করিয়েছি। ।দামটা যেমন বেশি দিয়ে মানুষ এই বাইক কিনে অন্য বাইক থেকে সেহেতু সবাই এসিয়াইয়ের থেকে বেস্ট সার্ভিস পাওয়ার অধিকার রাখেই। তবে প্রথম প্রথম সময়ের দাম দিতে পারত না সার্ভিস সেন্টারগুলা।ঢাকার বাহিরের সার্ভিস সেন্টারগুলার অবস্থা খুব একটা ভাল না এইটা সবাই জানে অস্বীকার করার কিছু নেই।তবে আগের চেয়ে এখন সার্ভিস অনেক ভাল এসিয়াইয়ের।মেগা ক্যাম্পেইনের জন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারে। এছাড়া এফাই বস রিপন ভাইয়ের কাছ থেকে একটা পেইড সার্ভিস নিয়েছি।
লং ট্যুর - স্টুডেন্ট মানুষ ইচ্ছা থাকলে ও সব জায়গা তে যেতে পারি না।বাসার পারমিশনও অন্যতম কারণ ট্যুর দিতে না পারার।তবে আজ পর্যন্ত আমি ২ বার ময়মসিংহ ,১ বার কুমিল্লা,১বার ভৈরব ট্যুর দিয়েছি।এছাড়া নিয়মিত গাজিপুর যাওয়া হয়।একদিন সর্বোচ্চ ৩৪৫ কিমি রাইড করেছি আমি।সপ্তাহে আমার এভারেজে ২০০+- কিমি চালানো হয়ে থাকে শুধু সিটিতেই।
সিকিউরিটি এলার্ম/লক - লাস্ট ১ বছর ধরে ট্যাস ভি ২ ইউজ করতেছি।এখন পর্যন্ত কোন প্রবলেম ফেস করিনি এমনকি ব্যাটারি ও বসে যায় নি।ভাল মনে হয়েছে ট্যাস লক আমার কাছে।
কি কি পরিবর্তন করেছি - এখন পর্যন্ত পরিবর্তন করেছি হর্ণ,হেডলাইট,এয়ার ফিল্টার,স্টক প্লাগ,ফুল চেইন সেট ,ব্রেক প্যাড,ব্রেক শু এবং ইঞ্জিন ওয়েল ফিল্টার (প্রতিবার ড্রেইন দিলেই বদলায় আমি)
বাইক নিয়ে আমি এই ১০০০০ কিমি পর্যন্ত সন্তুষ্ট পুরোপুরিভাবে। তবে রিসেন্টলি কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে।তার মধ্যে অন্যতম বল রেসার।কিছুদিন ধরে রানিং এ মনে হচ্ছে বাইক এক দিকে বেশি টানে।কিছুদিনের মধ্যে এই বল রেসার পরিবর্তন করতে হবে।এই বাইকের জাতীয় সমস্যা এখন বলতে গেলেই এটাই। এছাড়া ক্লাচ মাউনটেন এর প্রবলেম রয়েছে যা ভার্সন ১ ও ছিল। এটা আপগ্রেড করা হয়নি ।ক্লাচ মাউনটেন রাবার দুর্বল হবার কারণে এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে,তাই ক্লাচ্ ছাড়লে মাঝে মাঝে জার্ক করে উঠে। বাট এটা খুব একটা সমস্যা ফিল হয় না আমার।
আর হ্যাঁ,আমরা রাস্তায় নেগেটিভ কিছু দেখলেই অন্যের দোষ খুঁজতে শুরু করি।কিন্তু ভাই কেন!গলা যতই ফাটান পরিবর্তন আনতে হবে বলে লাভ নাই যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে পরিবর্তন হবেন না।রাস্তায় অন্য যানবাহন চালকের ভুল ত্রুটি না খুঁজে নিজে সভ্য মানুষের মত বাইক চালান দেখবেন সব কিছুই মধুর মত স্বচ্ছ ও স্মুথ মনে হচ্ছে।সকালে যখন বাসা থেকে হাসিমুখ করে বাইক নিয়ে বের হন ঠিক ওভাবেই যখন রাতে ফ্যামিলির মাঝে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে আসতে পারেন তার মধ্যেই স্বার্থকতা খুঁজার ট্রাই করুন দেখবেন ভাল লাগবে।এছাড়া দেখবেন নিজেকে বাইকার হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
Arnob Hardy
Moderator
Fuel Injection Club BD FCB