আমরা মোটরসাইকেল ভ্যালী চেষ্টা করে থাকি বাইকারদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকা বাইকগুলো নিয়ে টেস্ট রাইড রিভিউ প্রকাশ করতে। ঠিক এইবারও তার ব্যাতিক্রম কিছু হয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে মোটরসাইকেলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই সাথে লোকাল মার্কেটে ব্র্যান্ডগুলোর অন্যরকম এক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানী বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোটরসাইকেল নিয়ে এসে গ্রাহকদের মন জয় করছে। বর্তমান বাজারে উদীয়মান কিছু ব্র্যান্ডের মধ্যে ভালো পজিশন ধরে রেখেছে কিওয়ে। তারা স্টাইলিশ বাইক এবং ভালো ফিচারস সমৃদ্ধ বাইক বাজারে নিয়ে আসছে এবং ভালো ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন করে চলেছে।
কিওয়ে স্পোর্টস বাইকের পাশাপাশি ক্রুজার বাইকও বাজারে নিয়ে এসেছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ক্রুজার প্রেমী মানুষদের জন্য স্পীডোজ লিমিটেড বাংলাদেশে নিয়ে আসে ব্ল্যাক ম্যাট কালারের কিওয়ে সুপারলাইট। কীওয়ে সুপারলাইট ক্রুজারটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এন্ট্রি লেভেলের ক্রুজার হিসেবে জনপ্রিয়। বিশেষকরে এর ক্লাসিক ক্রুজার লুক জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন। ম্যাট কালো রং এর দুর্দান্ত লুক, স্পেশাস সীট, বড় ফুয়েল ট্যাংক এবং কালোর সাথে ক্রোমের ব্যবহার ক্রুজারটিকে আভিজাত্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে। ১৫০সিসির এই ক্রুজারটি লুক, কমফোর্ট এবং পারফরমেন্সের কারনে ইতমধ্যেই বাইকারদের নজর কাড়তে সমক্ষম হয়েছে।
বাইকটি নিয়ে আমরা টিম মোটরসাইকেলভ্যালীর অভিজ্ঞ টেস্ট রাইডারগন বিভিন্ন রাস্তায় এর পারফরমেন্স টেস্ট করেছি এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে টেস্ট রাইড রিভিউ প্রকাশ করতে যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করেছি বাইকটির সবকিছু দিক ভালো ভাবে টেস্ট করার। খারাপ রাস্তা, কাদা যুক্ত রাস্তা, হাইওয়ে এবং বিভিন্ন রাস্তায় বিভিন্ন ভাবে টেস্ট রাইড করি এবং আমাদের মুল উদ্দেশ্য থাকে যে বাইকটির খুঁটিনাটি কিছু বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরার জন্য। চলুন বাইকটি নিয়ে আমাদের টিম মোটরসাইকেলভ্যালীর টেস্ট রাইডারগন কি মতামত দেয় সেটি এক নজর দেখে নেওয়া যাক।
গঠন ও ডিজাইন
আমরা এর ডিজাইনে এবং গঠনে অনেক ধাতব অংশের ব্যবহার লক্ষ্য করেছি যার কারণে বেশ মজবুত গঠন অনুভব করা যায়। ম্যাট কালার, সুন্দর গঠন যেটা দেখলেই আশা করা যায় সকলের চোখ জুরিয়ে যাবে। অন্যদিকে ক্রজারটির হুইলবেজ ১৪৪০ মিমি থাকার ফলে আমরা অনেক কম ঝাঁকুনি ও সাসপেনশনের ভালো পারফরমেন্স অনুভব করেছি । তবে বাইকটির হুইলবেজ বেশী থাকার কারণে, শহরের মধ্যে বাইকটি চালানো একটু কষ্টকর হয়ে যায় তবে ফাকা রাস্তায় কিংবা হাইওয়েতে বাইকটি চলাচলের জন্য একদম পারফেক্ট । বিল্ড কোয়ালিটিও আমরা অনেক মজবুত অনুভব করেছি। অন্যদিকে গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স রয়েছে ১২০ মিমি এবং আমরা লক্ষ্য করেছি যে এর কম গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন থাকার কারণে স্পীড ব্রেকারের সাথে মাঝে মাঝে ঘষা খায়। বাইকটির ওজন প্রায় ১৩৪ কেজির মতো এবং ইঞ্জিন শক্তি ও কম ওজন থাকার ফলে বেশ ভালো স্পীড পাওয়া যায়।
ইঞ্জিন
ব্যাক ম্যাট কালারের এই ক্রুজারটি ইঞ্জিন শক্তি আমরা অনেক ভালো পেয়েছি। যারা হাইওয়েতে নরমাল স্পীড মেনে বাইক চালাতে চান তাদের জন্য আমরা মনে করি ইঞ্জিনের শক্তি একদম পারফেক্ট। ক্রুজারটি ইঞ্জিনে রয়েছে ১৫০ সিসির সিংগেল সিলিন্ডার, ৪ স্ট্রোক ইঞ্জিন রয়েছে এবং এই ইঞ্জিন ১২ বিএইচপি @ ৮৫০০ আরপিএম ম্যাক্স পাওয়ার এবং ১১ এন এম ৬০০০ আরপিএম ম্যাক্স টর্ক উৎপন্ন করতে সক্ষম। বিশাল আকারের এই ক্রজারটি কম ইঞ্জিন শক্তি এর স্পীডে খুব একটা বেশী প্রভাব ফেলেনা। ইঞ্জিনের শক্তিটা থ্রটল রেসপন্সের সাথে ধীরে ধীরে স্পীড তুলতে সক্ষম সাধারণত ক্রজার বাইকগুলো যেমন হয় আরকি। ইঞ্জিনের শব্দটা বেশ গম্ভীর এবং আশা করা যায় সকলেই ইঞ্জিনের শব্দটা পছন্দ হবে। মাইলেজ নিয়ে বলতে গেলে আমরা টিম মোটরসাইকেল্ভ্যালী শহরে এবং হাইওয়েতে মাইলেজ পেয়েছি ৩৫ থেকে ৪০ কিমি প্রতি লিটারে ।মাইলেজ ব্যাপারটা আসলে রাইডারের রাইডিং এটিটিউডের উপর নির্ভর করে।। সব কিছু মিলিয়ে আমরা টিম মোটরসাইকেল্ভ্যালী বলবো যে কিওয়ে সুপারলাইট ১৫০ সিসি এই ক্রজার বাইকটির ইঞ্জিন পারফরমেন্স বেশ দারুন।
সিটিং পজিশন
আমরা লক্ষ্য করেছি যে বাইকটির সিটিং পজিশনটার উচ্চতা( ৭৩০মিমি) বেশ নিচু যেগুলো সাধারণত ক্রুজার বাইকগুলোতে থাকে এবং সিটিং পজিশনও আমাদের কাছে খুবই আরামদায়ক মনে হয়েছে। রাইডারের সিটিং পজিশন অনেক প্রশস্ত। যারা লং রাইডে যেতে ইচ্ছুক তাদের জন্য খুবই আরামদায়ক সিটিং পজিশন তবে পিলিয়নের সিটটা আমাদের কাছে আরামদায়ক মনে হয়নি কারণ এর পেছনে কোন ব্যাকরেস্ট নাই তাই পিলিয়ন পিছনে বসে মাঝে মাঝে সমস্যা অনুভব করতে পারে।
জ্বালানী ট্যংক
বাইকটির ফুয়েল ট্যংকার একটু বিশাল এবং সুন্দর দেখতে যার কারণ ভিন্ন আউটলুক লক্ষ্য করা যায়। বাইকটিতে বিশাল আকৃতির ১৫ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফুয়েল ট্যংকার ব্যবহার করা হয়েছে যার কারণে তেলের শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে মুক্তি পাবেন এবং ঝামেলা বিহীন ভাবে লং ট্যুরে যেতে পারবেন। কালো রং এর ফুয়েল ট্যংকারের সাথে বড় আকারের ক্রোম ঢাকনা লাগানো হয়েছে এবং এই অংশটি ক্রুজারটি ডিজাইন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
ফূট রেস্ট
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার জন্য রয়েছে আরামদায়ক ফুটরেস্ট । এই ফুট রেস্টের ফলে রাইডার অনেক আরামের সাথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হবে। ঘরের মেঝেতে পা রেখে আমরা যেমন আরাম অনুভব করি ঠিক সেরকমই আরাম এনে দিবে এই ফুটরেস্ট । যদিও পেছনের ফুটরেস্টটা পিলিয়নের জন্য খুব একটা আরামদায়ক না এবং ফুট রেস্ট ছোট থাকার কারণে আমরা লক্ষ্য করেছি যে সাইড কভারের সাথে পা লেগে ময়লা হয়ে যায়।
হেডল্যাম্প
ক্রজারের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য বাইকটিতে বেশ বড় আকারের গোলাকার হেডল্যাম্প রয়েছে যেটা বেশ ভালো পরিমাণে আলো সরবরাহ করে। আমরা অন্ধকার রাস্তা,হাইওয়ে এবং বিভিন্ন রাস্তা এর হেডল্যাম্পের আলো পরীক্ষা করি এবং বেশ ভালো পরিমাণে আলো পাই এবং হেডল্যাম্পেটি গোলাকার হবার ফলে ক্লাসিক আউটলুক পাওয়া যায়।
টায়ার
ক্রুজারটির সামনে ১১০মিমি এবং পেছনের টায়ার ১৩০মিমি। সামনের হুইল ১৬ইঞ্চি এবং পেছনে ১৫ইঞ্চি। টায়ারগুলো ক্রুজারের লুক যেমন সুন্দর করেছে তেমনি রাইডিং কমফোর্ট বাড়িয়েছে। যদিও টায়ারগুলো টিউবলেস হলে আরও ভালো হতো।আমারা বৃষ্টি ভেজা রাস্তা এবং বিভিন্ন রাস্তায় টায়ারের গ্রিপ পরীক্ষা করে বেশ ভালো গ্রিপ পেয়েছি এবং এবং পেছনের চাকা কষে ব্রেক করলেও স্কীড করে না।
ব্রেক
ব্রেকিং এর দিক দিয়ে আমরা অনেক ভালো পারফরমেন্স পেয়েছি। সামনে ডিস্কব্রেক এবং পেছনের চাকায় ড্রাম ব্রেক ব্যবহার করা হয়েছে। বাইকের ওজন, মোটা টায়ার ব্রেকিং এর পারফরমেন্স বৃদ্ধি করেছে।
সাসপেনশন
সামনে টেলিস্কোপিক এবং পেছনে টুইনশক ব্যবহার করা হয়েছে। সামনের সাসপেনশন বেশ কার্যকরী হলেও পেছনের সাসপেনশন আমাদের কাছে কিছুটা শক্ত মনে হয়েছে যেটি সরাসরি চালকের জন্য কষ্টকর না হলেও পিলিয়নের জন্য কিছুটা কষ্টর বটে।তবে সব রাস্তায় আমরা দুটা সাসপেনশনের ভালো পারফরমেন্স পেয়েছি।
ইলেক্ট্রিক্যাল ও মিটার কনসোল
ইলেক্ট্রিক্যালও মিটার কনসোল দিক দিয়ে বাইকটি তার ক্রুজারের বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। পেছনের টেল ল্যাম্পের আকারটা বেশ বড় এবং স্বচ্ছ আলো যা পেছন থেকে অনায়াসেই বোঝা যায়, গোলাকার হেডল্যাম্পের কথা আমারা পূর্বেই আলোচনা করেছি, টেল ল্যাম্পের আলো পরিষ্কার বোঝা যায়।
এদিকে আমরা লক্ষ্য করেছি যে ক্রুজার বাইকটির সুইচগুলো একটু ভিন্ন ধরনের এবং এটা ইউরোপের হারলে ডেভিডসোন বাইকগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। আমরা বলতে পারি যে ক্রুজার বাইক হিসেবে যে রকম সুইচ থাকার কথা ঠিক সেরকমই রয়েছে। এদিকে মিটার কনসোলে আমরা লক্ষ্য করেছি যে আরপিএম মিটার এবং স্পিডোমিটার দুটাই এনালগ মিটার এবং ফুয়েল ইনডিকেটর মিটারটি ফুয়েল ট্যংকারের সাথে ক্রোম করা ঢাকনা দিয়ে সুন্দর করে সুসজ্জিত করা হয়েছে যা এর ক্রুজার বিশিষ্টের সাথে পুরোপুরি মানানসই ।
মন্দ দিক
- পিলিয়ন ফুটরেস্ট পজিশন
- পিলিয়ন ব্যাকরেস্ট না থাকা
- গ্র্যাব রেইল ধরে মোটেও আরামদায়ক নয়
- টিউবলেস টায়ার না থাকা
সবশেষে
বাইকটিকে টেস্ট রাইড করার পর আমাদের কাছে যেটা মনে হয়েছে সেটা হল- বাইকটি ক্রুজার হিসেবে তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। কমফোর্ট এবং বাইকের প্রতি পথচারীর মুগ্ধ দৃষ্টি আপনাকে বাইকের কম মাইলেজের কথা ভুলিয়ে দিবে। সবেশেষে আমরা তাদেরকেই এই বাইকটি কিনতে বলবো যারা স্পীড, স্পোর্টস এবং মাইলেজের থেকেও ট্যুরে কমফোর্টকে বেশি গুরুত্ব দেন। কিশোর অপেক্ষা তরুন এবং মাঝ বয়সী লোকের ব্যক্তিত্বের সাথে বাইকটি বেশি মানানসই। পরিশেষে বাইকের লুক, গঠন, পারফরমেন্সের সাথে দাম তুলনা করলে, দামের তুলনায় ক্রজারটির পারফরমেন্স বেশ ভালো বলেই আমরা মনে করি।