-আমি একটা বাইক কিনতে চাচ্ছি, ৬২ হাজার পরবে
-এক লাখ ৬২?
-না শুধু ৬২
-সেকেন্ডহ্যান্ড ?
-না ব্র্যান্ড নিউ
-কি কস ব্যাটা ! এত কমে তোরে বাইক কে দিবো ?
-রানার, তাও আবার কিস্তিতে
অনেকটা এইরকমই ছিলো আমার আর আমার এক বন্ধুর কথোপকথনটা | আমি নিজেও কিছুটা সন্দিহান ছিলাম যখন আমি বাইকটার ব্যাপারে প্রথম জানি | এত কমে বাইক ! ভালো তো ? অনেক ঘেটেও নেটে তেমন আহামরি কোন ইনফরমেশন পেলাম না | নতুন বাইক, তাই কোন রিভিউ ও নাই বলা চলে; এমনকি রানারের সেলস ডিপার্টমেন্ট এর কাছেও কোন সঠিক ইনফরমেশন পাই নাই কেবল মাত্র এটা ৮৬ সিসির বাইক আর দাম ৬২ হাজার বাদে |
হঠাৎ করেই ছোট বেলার ধামাচাপা দেয়া সখটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল গত বছর আগস্টের দিকে | সাধ ছিল কিন্তু সাধ্য ছিল না | তাই ইউটিউব আর দেশি মোটরসাইকেল সাইটগুলোতে ঘাটাঘাটি করে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতাম | এভাবেই একদিন চোখে পরল রানারের আরেকটা বাইকের রিভিউ, দাম ও কম আবার কিস্তিও আছে! আগ্রহ আরো বাড়ল বাইক আর টি এর কথা পড়ে | বাসায় রাজি করানো, বন্ধুদের রাজি করানো ও মোটামুটি শেষ এখন বাইক পছন্দ করার পালা | মনে মনে রানার চিতা নেয়ার প্লান করেই সেপ্টেম্বরের এক শুক্রবার রানারের কাজিপাড়া শো-রুমে যাই | চিতা স্টকে নাই তাই ফর্ম ফিলাপ করে অন্য বাইকগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম | তখনি নজর কাড়ল আর টি, আর কাড়বেই বা না কেন ? দেশি ম্যানুফ্যাকচারার গুলোর মধ্যে এত সুন্দর ডিজাইন খুব কমই দেখা যায় |
প্রথমেই বলে নেই, আমি লম্বায় 5'6" হলেও পাটকাঠি টাইপ শুকনো | তাই ভারী বাইকগুলোতে মোটেও কমফোর্টেবল ফিল করিনা | কিন্তু আরটির ব্যাপারটা পুরোটাই অন্যরকম, বসার সাথে সাথেই কেমন যেন নিজের নিজের মনে হল | ছোটখাট কিউট কিন্তু চড়ে বসলে আলাদা একটা কনফিডেন্স পাওয়া যায় | তো পুরাই কনফিউজড হয়ে বাসায় আসলাম, রিভিউ আর এক্সপার্ট অপিনিয়ন বলে চিতা কিংবা ডিলাক্স আর মন বলে আরটি | শেষমেশ মনেরই জয় হল, নভেম্বর এর ১০ তারিখ আমার সেজো খালা আর বন্ধু রুমিকে গ্যারান্টর হিসেবে নিয়ে গিয়ে নিয়ে আসলাম আমার লালপরীটাকে |
আরটি কেনার আগে বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা মাত্র ১০ মিনিটের, কিন্তু সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা থাকায় কিছুটা সাহস পাচ্ছিলাম মনে মনে | প্রথম ৪০০ কিলো এলাকাতেই চালিয়ে হাত পাকিয়ে নেই, এর পর আস্তে আস্তে ঢাকার রাস্তায় ওঠার সাহস হয় | প্রথম ১০০ কিলোমিটার তেমন কোন প্রব্লেম না হলেও ফিল করছিলাম হাতের ব্রেকটার রেস্পন্স তেমন ভালো না আর পায়েরটা ফুট পেগের লেভেল থেকে বেশ খানিকটা ওপরে তাই আনইজি লাগে একটু |
প্রব্লেমটা শুরু হল তিনদিন পর, অফিস থেকে বাসায় এসে দেখি বাইকের নিচে অনেকখানি ফুয়েল পড়ে আছে | তেলের টাংকি আর ফুয়েল লাইনের জয়েন্ট দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে তেল পরছে | বিপদে পরে গেলাম কারন কোন রকম কাগজপত্র ছাড়া সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া অনেক রিস্কি আর এয়ারপোর্ট থেকে একা একা চালিয়ে যাওয়ার মত দক্ষতা তখনো আসেনি | তাই এলাকার এক মেকানিকের কাছে নিয়ে গেলাম , সে জোড়াতালি দিয়ে কি করল ঠিক বুঝলাম না | তেল পরা বন্ধ হলেও দেখা দিল নতুন উপসর্গ, চলতে চলতে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায় এবং ৫/৭ মিনিট সেলফ/কিক কোনভাবেই স্টার্ট নেয় না (পরে বুঝেছি ফুয়েল ফ্লোতে প্রব্লেম এর কারনে এই পেইন পোহাতে হয়েছিল) |
এই ঝামেলার কারনে মাত্র ২৪০ কি.মি.তেই এক বন্ধুকে নিয়ে কোন রকম কাগজ পত্র ছাড়াই চলে গেলাম সাতরাস্তা সারভিসিং এর জন্য | সারভিসিং এর পর প্রব্লেমটা সলভ হলেও পুরোপুরিভাবে গেলোনা | স্টার্ট আগের মত বন্ধ হয় না, ব্রেক গুলো আগের থেকে বেটার কাজ করছে, গিয়ার আগের থেকে স্মুথ কিন্তু তারপরও পুরো সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না| তাই এলাকারই আরেকটা ক্ষুদে মেকানিকের কাছে নিয়ে গেলাম | মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে মুশকিল আসান ! ব্রেক পারফেক্ট রেসপন্স করছে, গিয়ার শিফটিং মাখন আর বাইক সকালে বের করার সময় কিক দিয়ে স্টার্ট দিয়ে ৫ মিনিট ইঞ্জিন গরম করে চালানো স্টার্ট করলে স্টার্ট বন্ধ হবার প্রব্লেমও ৯৫% সলভ (মাঝে সাঝে ক্লাচ/পিকাপ এডজাস্টমেন্টে ভুল হয়ায় স্টার্ট বন্ধ হলেও চলা অবস্থায় সেল্ফ দিলে বাইক আবার স্টার্ট নেয়) |
৮০০ কি.মি. চালানো শেষে বাইকটির ভালো দিক আর খারাপ দিকগুলো যা পেয়েছি নিচে তুলে ধরলাম :
ভালো দিক :
১. আউটলুক : লুকস বিবেচনায় আমার কাছে বাইকটি ১০/১০ পাবে | একই সাথে ইউনিক,স্টাইলিশ আর নজরকাড়া রং বাইকটিকে এই সেগমেন্টের অন্যান্য বাইক থেকে বেশখানিকটা এগিয়ে রাখে | (কত বার রাস্তায় লোকজন থামিয়ে বাইকটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে হিসাব নেই | সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে বাইকটা দেখতে অস্থির !)
২. স্পিড : ব্রেকিং পিরিয়ড চলছে তাই স্পিড বেশি তোলা হয় না| তারপরও বলতে দ্বিধা নেই আরটির স্পিড আমাকে বিন্দু পরিমান হতাশ করেনি ! ৫০০ কি.মি. পার হবার পরে প্রায় প্রতিদিনই ৬০+ কি.মি./ঘন্টা বেগে চালানো হয়েছে, টপ স্পিড তুলেছি ৭৫ কিন্তু মনে হচ্ছিলো আরো উঠবে | রাস্তা শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিন আর তোলা হয়নি | ব্রেকইন পিরিয়ড শেষে টপস্পিড চেক করলে ৮০ কি.মি./ঘন্টা পাবো এই ব্যাপারে আমি কনফিডেন্ট | সাথে আছে রেডি পিকআপ ! ঢাকার রাস্তায় রেডি পিকআপ গুরুত্ব আপনাদের কারো অজানা নেই | আরটি নিয়ে জ্যামের মধ্যে কিংবা পার্শ্বরাস্তায় কখনো রেডি পিকআপ এর জন্য লজ্জায় পরতে হয়নি, বরং আর দশটা ১০০ সি.সি. বাইকের সাথে তুলনা করা যায় এর রেডি পিকআপকে |
৩. কন্ট্রোলিং : নতুন চালক হিসেবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আরটি এর মত সহজ আর Easy to control বাইক খুব কমই আছে | বন্ধু-বান্ধব যারা এর আগে বাইক চালায়নি সবাইকে মিনিট দশেকের মধ্যে আরটি দিয়ে চালানো শিখিয়ে দিয়েছি | ছোটখাট হবার কারনে ঢাকার নিত্যনৈমিত্তিক জ্যামে আরামসে নড়াচড়া করা যায় | সব বাইকেই কম বেশি ভাইব্রেশন হয় বেশি স্পিডে কিন্তু আর টিতে এই ভাইব্রেশনের মাত্রা খুবই কম | কেউ কেউ
অভিযোগ করে পিলিয়ন সহ নাকি এটাতে কমফোর্ট পাওয়া যায় না, অত্যন্ত বিনীতভাবে তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি | পিলিয়নসহ কন্ট্রোলিং এ কোন প্রব্লেম ফেস করি নাই বরং পিলিয়ন থাকলে হাই স্পিডে খুব স্মুথলি চালানো যায় | উচা-নিচা এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় বহুবার চালিয়েছি বিন্দুমাত্র সমস্যা ছাড়া | ফ্লাইওভার বা ব্রিজে কোন ঝামেলা হয়না |
আরেকটা কথা বিশেষ ভাবে না বললেই নয়, আরটি নতুন ড্রাইভারদের কে বাড়তি একটা কনফিডেন্স দেয় | মনে হয় যতই ভুল করিনা কেন বাইক কখনো আউট অব কন্ট্রোল হবেনা!
৪. বিল্ড কোয়ালিটি: ব্যাপারটা হয়ত কারো কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু এটাই সত্যি,আরটির বিল্ড কোয়ালিটি ওভারঅল ভালো | হ্যান্ডেল বার,চেসিস,ফুটপেগ, কিংবা হেডকিট কোনটাই ঠুনকো মনে হয় না | সিটটাও আরামদায়ক আর স্টাইলিশ | সুইচ গুলো চমৎকার কাজ করছে আর অয়ারিংও স্ট্যান্ডার্ড |
৫. ব্রেকিং : ব্রেকিংটা প্রথম দিকে আশানুরূপ না পেলেও টিউনিং করার পরে এখন পারফেক্ট পারফরমেন্স পাচ্ছি | দেখেন বাইকটায় দুইটাই ড্রাম ব্রেক তাই কেউ ডিস্ক ব্রেকের সাথে তুলনা করতে যাবেন না প্লিজ | হাতের ব্রেক-পায়ের ব্রেক মিলিয়ে ধরতে পারলে ইনশাআল্লাহ কখনো কোনদিন বিপদে পরতে হবে না | ইমারজেন্সি ব্রেকিং এ এখন পর্যন্ত নিরাশ হইনি |
৬. মাইলেজ : মাইলেজ ৫০ এর মত পাচ্ছি এখন| ব্রেকইন পিরিয়ড এর পরে আরেকটু বাড়বে আশা করছি |
খারাপ দিক: বাইকটার কিছু খারাপ দিক থাকলেও কোনটাই তেমন গুরুতর না | মানিয়ে নেয়ার ইচ্ছা থাকলে আর অল্প কিছু খরচেই এগুলি দূর করা যায় |
১. ফুয়েল ইন্ডিকেটর প্রাথমিক অবস্থায় কাজ করছিল না, সারভিসিং এর সময় রানারের টেকনিশিয়ান ঠিক করে দিয়ে ছিল | এখন কাজ চালানোর মত রিডিং দেয় |
২. আলাদা কোন রেভ কাউন্টার নেই তাই ইঞ্জিনের আওয়াজ আর হাতের থ্রটল পজিশন থেকেই আরপিএম আন্দাজ করে নিতে হবে | স্পিড মিটারটার লুক আমার ভাললাগেনি |
৩. হেডলাইটের আলো কাজ চালানোর মত হলেও আহামরি কিছু না | (মটো এলইডি লাগাব কিছুদিনের মধ্যে তখন আর প্রব্লেম হবেনা আশা করি)
৪. বাইকটার সাইজ ছোট, তিনজন কম্ফোরটেবলি বসা যায় না |
৫. পিছনের সাসপেনশনটা আরো ভাল হতে পারত |
৬. পিছনের চাকা চিকন তাই কন্ট্রোলিং এ তেমন কোন প্রব্লেম না হলেও ঠিক মত ব্রেক করতে না পারলে স্কিড করবে | ঠিক মত কথাটা ইউজ করার কারন প্রথম দিকে আমার অনেক বেশি স্কিড করত, এখন আর খুব একটা করেনা স্কিড | (এলাকার মেকানিক বলেছে পালসারের পিছের চাকা লাগানো যাবে পরে)
৭. শাড়ি গার্ড কিংবা বাম্পার নাই| (অনেক আর টি ইউজার ভাই অলরেডি স্বল্প খরচে লাগিয়ে নিয়েছে দেখলাম)
৮. সাইড কভারটা প্লাস্টিকের, ফেটে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি |(প্লাস্টিকের সাইড বক্সটা আর কিছুদিন পরে চেঞ্জ করে স্টিলের একটা লাগিয়ে নিব ঠিক করেছি, তাহলে বিল্ড কোয়ালিটিতে আর কোন ঘাটতি থাকবে না|)
পরিশেষে বলতে চাই, আমি কোন বাইক এক্সপার্ট না, আরটি ই আমার প্রথম বাইক | হ্যা, কিছু প্রব্লেম ফেস করেছি সত্যি কিন্তু এটাও সত্যি ৬২ হাজার (এখন ৬৪ হাজার) টাকায় এমন একটি বাইকের মালিক হব কোন দিন স্বপ্নেও ভাবিনি | ৮০০ কি.মি পরে আজকে যখন রিভিউ লিখতে বসেছি মুখে এক চিলতে হাসি নিয়েই বসেছি; এ হাসি একজন গর্বিত মোটরসাইকেল মালিকের সন্তুষ্টির হাসি |
আসিফ জাহান
প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোট-খাট চাকরিজীবী |