বেশিরভাগ মোটরসাইকেল মালিক মোটরসাইকেল কেনে শখেবশে। কেউ পেশাগত দায়িত্ব পালনের খাতিরে ক্রয় করলেও তা গড়িয়ে যায় বিনোদন, ভ্রমণ ইত্যাদিতে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সহায়ক হিসেবে আমিও মোটর সাইকেল ক্রয় করি বহু কষ্টেসৃষ্টে। কিন্তু এটা আজ আমার কাছে বড্ড ভালবাসার বস্তুতে পরিণত হয়েছে।আমি রিকু আমির পেশায় সাংবাদিক বাইক চালাতে খুব ভালোবাসি এবং বাইক নিয়ে ঘুরতে যে কী ভালো লাগে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি সুজুকি জিক্সার বাইকটি ব্যবহার করছি এবং ব্যবহার থেকে প্রাপ্ত কিছু অভিজ্ঞতা আজ আমি মোটরসাইকেল ভ্যালীর মাধ্যমে শেয়ার করবো।
ডিজাইন, বিল্ট কোয়ালিটি ও কেনার কারণ : Suzuki Gixxer 2017 মডেল, ডাবল ডিস্ক, ব্ল্যাক কালার ক্রয় করি ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে। ক্রয় করা হয়েছিল- সোনারগাঁও মটরসর, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা থেকে। এর প্রতি ভালবাসা জন্মানোর প্রধান কারণগুলো হলো- ডিজাইন। এর ফুয়েল ট্যাংক, হ্যান্ডেল সিটিং পজিশন, টায়ার ইত্যাদি সবকিছুতেই দেখেছিলাম অনন্য সৌন্দর্যতা এবং কার্যকারিতা। এর ডিজাইন নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ বা আপত্তি নেই। অত্যন্ত সুন্দরভাবে এর ডিজাইন করা হয়েছে। তবে পা-দানি, গিয়ার লিভার রড আরও দৃষ্টি নন্দন করলে ভাল লাগত। কালার কোয়ালিটি সন্তোষজনক।
সাসপেনশন, টায়ার, ব্রেকিং-কন্ট্রোলিং : এর টায়ার, ব্রেকিং-কন্ট্রোলিং অসাধারণ। হাই স্পিডেও খুব সহজে গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম। আত্মবিশ্বাসের সাথে বেশ ভাল কর্নার করা যায় এবং কিছু কিছু মূহুর্তে বাড়তি ঝুঁকি নিয়েও চালাতে সক্ষম হতাম। যেহেতু পেছনের টায়ার ১৩০ ছিল। সুতরাং বোঝাই যায়। এর রিম ডিজাইন অত্যন্ত সুন্দর। সানপেনশন খুব একটা ভাল লাগেনি। অফরোডে ঝাঁকুনি শক্তপোক্তভাবে অনূভুত হতো।
ইঞ্জিন পারফরমেন্স : Suzuki Gixxer 2017 আমি ৭ হাজার কিলোমিটার চালিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হই শুধুমাত্র ইঞ্জিন পারফরম্যান্সের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে। সিটিতে সন্তষ্টই ছিলাম, ঝামেলা পাকে লম্বা ভ্রমণপথে।
গতি : এটা গতির দানব। খুব সহজে ১০০ কিলো স্পিড তোলা কোনো ব্যাপারই না। ১২০ এর পরে স্পিড বৃদ্ধিতে একটু কষ্ট হয়। একজস্ট পাইপের সাউন্ড গলা ফাটিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। থ্রটল রেসপন্স খুবই ভাল এবং স্মুথ। একইসাথে গিয়ার শিফটিং চ্যানেলও বেস্ট। এটা দিয়ে আমি সর্বোচ্চ ১২৫ কিলোমিটার গতি তুলতে সক্ষম হই (পিলিয়ন ছিল না)।
মাইলেজ : শোরুম থেকে বের করা থেকে বিক্রি পর্যন্ত ঢাকায় প্রতি লিটার অকটেনে ৪০ কিলো এবং মহাসড়কে ৪২ কিলো চলতে পেরেছি। এটা নিয়ে আমি ভীষণ সন্তুষ্ট।
সিটিং পজিশন : এর হ্যান্ডেল বার অত্যন্ত আরামদায়ক এবং সিটিং পজিশন অত্যন্ত ভাল। দীর্ঘক্ষণ চালিয়েও শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা অনুভূত হতো না।
দাম : তীব্র বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার আগ পর্যন্ত দাম নিয়ে তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু অভিজ্ঞতাটির সম্মুখীন হবার পর মনে হয়েছে- টাকা দিয়ে কুমির কিনেছি। মান তুলনায় এর দাম বেশি।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা : পেশাগতভাবে সাংবাদিক (দৈনিক জাগরণ এর রিপোর্টার) হবার সুবাদে ঢাকার এখান থেকে ওখানে জিক্সার নিয়ে চলাচল করেছি যখন-তখন। এছাড়া অফিসিয়াল কাজে ঢাকার বাইরে দূরবর্তী অঞ্চলেও গমন করেছি। ব্যস্ততার মাঝে একটু ছুটিছাটা পেলে জিক্সার নিয়ে হারিয়ে যেতাম। ৭ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে ভ্রমণ করেছি ৩ বার। প্রথমদিকে ২ হাজার কিলো মিটার পর্যন্ত ব্রেক ইন পিরিয়ডটা শুধু প্রপারলি রক্ষা করি।
Suzuki Gixxer 2017 নিয়ে প্রথম ভ্রমণ করি কুয়াকাটা। একা ভ্রমণ করেছি। দারুণ গতি, কন্ট্রোল, ব্রেক, মাইলেজ ফিল করেছি। কুয়াকাটা থেকে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, বরিশাল শহর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা হয়ে ঢাকায় ফিরি লম্বা ছুটির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে। এর মাসখানেকের মধ্যে ছুটে যাই সীতাকুণ্ডের কুমিরা ব্রিজে। এরপর নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সফলভাবে ভ্রমণ সমাপ্ত করি। শুধুমাত্র কুমিরা ব্রিজে ভ্রমণের সময় পিলিয়ন ছিল।
লম্বা ভ্রমণে তিক্ত অভিজ্ঞতা : Suzuki Gixxer 2017 নিয়ে মহাসড়কে গতি, কন্ট্রোল, ব্রেক, মাইলেজ নিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ অভিযোগ বা খারাপ লাগা নেই। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ইঞ্জিনে। তিনটি ভ্রমণের পরই ইঞ্জিনে ভয়ানক ত্রুটি দেখা দিল। এর ক্যাম শ্যাফটের বিয়ারিং ভেঙে যেতে লাগল। এটা বুঝতে পারতাম, টাইম চেইনের পাশ থেকে কট কট শব্দ নির্গত হওয়া শুনে।এটা দেখেশুনে শুধু আমি-ই নই, ঢাকার বিজ্ঞ বিজ্ঞ কারিগর এবং বাংলাদেশে সুজুকির অফিসিয়াল পরিবেশক র্যানকন মোটরস লিমিটেডের চোখও কপালে উঠেছিল। মোট তিনবার একই সমস্যা ঘুরে ফিরে আমার জিক্সারের ভাগ্যে ধরা দিয়েছিল। যেটা আমাকে হতাশ করে মারাত্মকভাবে। ফাইনালি আমার কাছে মনে হয়েছে- জিক্সার দিয়ে আর যাই হোক, দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। এর ইঞ্জিনের সেই সামর্থ নেই। এর ন্যাচারই এমন।
সার্ভিস সেন্টার – আমি মোট তিনটি ফ্রি সার্ভিস করাতে সক্ষম হয়েছিলাম। এ সার্ভিসগুলো সন্তুষজনকভাবে পেয়েছিলাম। যেহেতু ইঞ্জিনের ওয়ারেন্টি ছিল ২ বছরের সেহেতু ক্যাম শ্যাফটের বিয়ারিং ভেঙে যাওয়ায় যেতে হতো ঢাকার তেজগাঁওস্থ সুজুকি সার্ভিস ক্যাফেতে। সেখানের কর্মীরা যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলেন কাস্টমারের সাথে। কিন্তু আমার সমস্যার সমাধান দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।এমনকি এ সমস্যার জন্য তারা আমার উপর জোরপূর্বক দায় চাপিয়ে ওয়ারেন্টি প্রদান থেকে বিরত থাকার অপকৌশলও প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। প্রথম সমস্যার সময় এটা ছিল না । পরের দুই বারের সময় এই অপকৌশলগুলো প্রয়োগের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। শুধু একটি কারণে তারা সফল হতে পারেননি। আমি সার্ভিস বুক অনুযায়ী সবকিছু মেন্টেইন করতাম। তার রেকর্ডও ছিল।
প্রথম ভ্রমণ শেষে ২৯৩০ কিলো মিটার চলাবস্থায় ইঞ্জিনের সাউন্ড বিকৃত হয় যায়। এরপর সুজুকি তেজগাঁও সার্ভিস ক্যাফেতে বাইকটি নিয়ে গেলে সনাক্ত হয়, ইঞ্জিনের ক্যাম শ্যাফট এর বড় বিয়ারিং (টাইম চেইন স্পোকেট সংলগ্ন) ভেঙে গেছে। দুই বছরের ইঞ্জিন ওয়ারেন্টি অনুযায়ী- আমি সার্ভিস ফ্রি পাই এবং ফ্রি বিয়ারিং রিপ্লেস করা হয়।
দ্বিতীয় ভ্রমণ শেষে ৪৬৩৮ কিলোমিটারে যখন পৌঁছলাম, তখন ইঞ্জিন সাউন্ড আবার বিকৃতি হয়। তবে প্রথমবারের মতন মারাত্মক বিকৃতি ছিল না। তখনও আমি সার্ভিস ক্যাফেতে যাই, তারিখ ২৮ জুন, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ। এবারও সনাক্ত হলো- ক্যাম শ্যাফটেরই ছোট বিয়ারিং ভেঙে গেছে। প্রথমবার ভেঙে যাওয়া বড় বিয়ারিং এর বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত এই ছোট বিয়ারিং।এসময় সার্ভিস সেন্টারের কর্মকর্তারা আমাকে অভিযুক্ত করার চেষ্ট করে বলেন- আমি বাইক জোরে চালাই, আমি বেশি ড্রাইভ করি। যা অত্যন্ত অপেশাদার আচরণ বলে মনে করি। এ ধরণের দানবীয় বাইকের সাথে কর্মকর্তাদের কথাবার্তা যায় না। ইঞ্জিন ওয়ারেন্টি থাকা সত্বেও এ দফা সার্ভিসের সময় আমার কাছ থেকে বিয়ারিং এর দামবাবদ চার্জ করা হয় ২৩১ টাকা।এসময় সার্ভিস সেন্টারের কর্মকর্তারা আমাকে অভিযুক্ত করার চেষ্ট করে বলেন- আমি বাইক জোরে চালাই, আমি বেশি ড্রাইভ করি। যা অত্যন্ত অপেশাদার আচরণ বলে মনে করি। এ ধরণের দানবীয় বাইকের সাথে কর্মকর্তাদের কথাবার্তা যায় না। ইঞ্জিন ওয়ারেন্টি থাকা সত্বেও এ দফা সার্ভিসের সময় আমার কাছ থেকে বিয়ারিং এর দামবাবদ চার্জ করা হয় ২৩১ টাকা।
এসময় পরামর্শ দেয়া হলো- ১০০০ কিলো পর্যন্ত গতি ৬০ এর বেশি না উঠতে। আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালনও করি। এছাড়া বলা হয়- ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার পর ওই বিয়ারিংয়ে ইঞ্জিন অয়েল পাস হবার কথা। যদি না হয় বা কম হয়, সেক্ষেত্রে চলতে চলতে এক পর্যায়ে বিয়ারিং গরম হয়ে ভেঙে যায়। এবার সেই তেল পাসিং রুট ভাল করে চেক করা হয়েছে। আর কোনো সমস্যা হবে না।সে অনুযায়ী- ১০০০ কিলোমিটার ৬০ এর বেশি গতি না তুলে যখন বাইক চালাতে থাকলাম, একদিন ফলোআপের জন্য একজন কর্মকর্তা সুজুকি ক্যাফেতে ডাকেন আমাকে। চেক করে দেখেন, সবঠিক আছে। এরপর বাইক ভালই চলছিল।
১৬ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) ২০১৮ রাতে খেয়াল করলাম সেই ক্যাম শ্যাফটের স্থান থেকে বিকৃত শব্দ নির্গত হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইল না, এই সমস্যা সেইসব সমস্যা। এরপর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করি তেজগাঁও ক্যাফেতে। শুক্রবার (১৭ আগস্ট) ক্যাফেতে যেতে বলা হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ শুক্রবার সকালে বাইক স্টার্ট নিচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার কাছাকাছি সুজুকি অনুমোদিত সার্ভিস সেন্টার ম্যাবস ইউনিয়ন মটরসে যাই। সেখানে কাজের ভীষণ চাপ থাকায় তিনদিন পর অর্থাৎ ১৯ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় বাইকটি গ্রহণ করি, বিল পরিশোধ করি ৮০০ টাকা।
ম্যাবসেও সনাক্ত হয় ক্যামের ছোট বিয়ারিং ভেঙেছে। যেটা দ্বিতীয়বার ভেঙে ছিল। এখানে আমার বাইক মেরামত করে সোহেল নামের একজন কারিগর। তার ভাষ্য অনুযায়ী- ক্যামের নিচে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি ও উপরে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি যখন চার প্রান্তের নাট্ দিয়ে টাইট করা হয় তখন ক্যাম শ্যাফট জ্যাম হয়ে যায়। এ সমস্যা দূর করার জন্য সে ক্যাম শ্যাফটে লেদ মেশিনের সহযোগিতা নেয় এবং উপরের বাটিটা যাতে ক্যামে ওভার প্রেশার ক্রিয়েট না করে সেজন্য হাতে কিছু কাজ করে।
কাজ করার সময় সোহেল আমাকে দেখান, ক্যামে যে দণ্ডের মধ্যে বিয়ারিং লাগানো থাকে, সেটার এক প্রান্ত নীলচে ভাব ধারণ করেছে। তার মানে এটা মাত্রাতিরিক্ত গরম হয়ে নীলচে বর্ণ ধারণ করে। এই নীলচে বর্ণ ধারণ করা অংশের সাথেই সেই ছোট বিয়ারিং এবং সেই বিয়ারিং এখন পর্যন্ত দুবার ভেঙেছে।
পুরো বিষয়টি ক্যাফের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে আমি ২০ আগস্ট, ২০১৮ দুপুরে সার্ভিস ক্যাফেতে গিয়ে বর্ণনা করি। তিনি শুনে খুব দুঃখপ্রকাশ করেন এবং আমাকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
কিন্তু আমি অতিমাত্রায় আস্থাহীনতায় ভুগছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সুজুকি ক্যাফে আমার সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে সক্ষম। হয়ত সক্ষম, কিন্তু আমি সেটা থেকে আমি বঞ্চিত ছিলাম বোধ হয়। বেশকিছু বিজ্ঞ কারিগরদের ভাষ্য- এটা ম্যানুফ্যাকচারিং ফল্ট। কিন্তু সুজুকি কর্তৃপক্ষ আমার সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। Suzuki Gixxer 2017 বিক্রি করি আগস্ট ২০১৮ এর শেষ সপ্তাহে। এরপর আমি শিফট করি বাজাজ পালসার এনএস ১৬০ তে।