ABS, CBS, DCBS এবং CABS ব্রেকিং সিস্টেম
হোন্ডা একটা ব্রান্ড নেম। অথচ এই ব্রান্ড নেম আমাদের মধ্যে এমন ইমপ্যাক্ট ফেলে গিয়েছে, আজো আমরা অনেকেই মোটরসাইকেল বলতে হোন্ডা বুঝে থাকি। হোন্ডা এইচএস১০০, সিজি ১২৫, সিডি ৮০ বা আরো আগে এস ১১০ বাইক গুলি তাদের অসাধারণ কার্যক্ষমতা দিয়ে আমাদের এখনো হিপ্নোটাইজ করে রেখেছে। শুধু আমাদের স্বল্প শিক্ষিত দেশেই নয় পৃথিবীর সব জনপদেই যেখানে সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে হোন্ডা একটা পরিচিত ব্রান্ড। হোন্ডার সেই সুবর্ন যুগ আর আমাদের দেশে এখন নাই,মুলত সিসির লিমিটেশান, ইন্ডিয়ান মার্কেটের চাহিদা, রুচির সাথে আমাদের জোর করে খাপ খাওনোর চেষ্টা, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত যেমন দায়ী অন্যদিকে ইন্ডিয়ান মার্কেটের স্কুটির বাজার দখল নিতে গিয়ে বাইক সেগমেন্টে হোন্ডার কম মনযোগকেও দায়ী করা যায়।
না আজ আমি হোন্ডার কোনও নির্দিষ্ট বাইক নিয়ে লিখবো না বরং কিছু ব্রেকিং সিস্টেম নিয়ে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্। বেশ কিছুদিন থেকেই ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেল গুলিতে অক্ষয় কুমারের একটা এড চোখে পড়ছিল, একটা গ্লোব নিয়ে তিনি ব্যালেন্স করছেন । হোন্ডার Combi-Brake System (CBS) এডের মূল বিষয়বস্তু। এই বিষয়টি নিয়ে লিখার ইচ্ছা ছিল । হোন্ডার রিসার্চ টিম জগত বিখ্যাত। তারা বাইকে এমন অনেক নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে যা আগে কখনি ছিলো না। হোন্ডা সবসময়ই তাদের রাইডারদের সেফটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। বাইকের সেফটি দু ধরনের, এক্টিভ সেফটি এবং প্যাসিভ সেফটি। কোন সন্দেহ নাই বাইকের এক্টিভ সেফটির মধ্যে পড়ে ব্রেকিং সিস্টেম।
১৯৫৯ সালে Soichiro Honda হোন্ডার ফাউন্ডার ABS ব্রেকিং সিস্টেমের জন্য পেটেন্টের আবেদন করেন। ১৯৬৯ সালে হোন্ডা প্রথম ফ্রন্ট ডিস্ক ব্রেক ব্যবহার করে তাদের CB750 Four বাইকে। ১৯৮৩ সালে হোন্ডা প্রথম Combi-Brake System ব্যবহার করে GL1100 Gold Wing এ। ১৯৮৭ সালে ABS ব্রেকিং সিস্টেমের জন্য mechanical oil pressure control system উদ্ভাবন করে । The first electronically-controlled Antilock Brake and Traction Control System উদ্ভাবন করে শুধুমাত্র বাইকের জন্যই ১৯৯২ সালে । বাইকটি ছিল ST1100 Pan-European ABS+TCS sports tourer. ১৯৯৩ সালে হোন্ডা প্রথম ডুয়েল কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেম উদ্ভাবন করে। এর ফলে আপনি সামনের বা পেছনের যে ব্রেকই চাপ দেন উভয় ব্রেকই বাইকের ওয়েট বুঝে সমভাবে ডিস্ট্রিবিউট হয়ে যাবে। বাইকটি ছিল CBR1000F sports tourer। ১৯৯৫ সালে ৫০ সিসির স্কুটারে( Live Dio ST scooter ) প্রথম Integrated front and rear ABS এর ব্যবহার করে হোন্ডা।
উপরে ব্রেকিং নিয়ে হোন্ডার রিসার্চের কিছু উল্লেযগ্য অংশ তুলে ধরলাম। এর বাইরেও তাদের ব্রেকিং নিয়ে আরও উদ্ভাবন আছে যা এই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব না।
এতক্ষণ পড়ার পরে নিসচয় আপনার মনে কিছু প্রশ্ন জমা হয়েছে । আসুন প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।
ABS ব্রেকিং সিস্টেম কি? সুবিধা কি?
এবিএস ব্রেকিং নিয়ে আমাদের একটা আলাদা আর্টিকেল আছে। আমি এখানে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করবো। ইমারজেন্সি মুহুর্তে বা পিচ্ছিল রাস্তায় আপনি যদি আচমকা ব্রেক করে বসেন তবে চাকার ঘুর্নন বন্ধ হয়ে চাকা লক হয়ে যেতে পারে। চাকা লক হবার কারনে টায়ারের মোমেন্টাম না থাকায় ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাবার অধিক সম্ভাবনা তৈরি হয়। মনে রাখবেন বাইকের ব্যালেন্স একবার হারালে কিন্তু এর ব্রেকিং সিস্টেম তখন আর তেমন কাজ করে না। ABS এর মাধ্যমে চাকার ঘুর্নন গতি কার্যকরভাবে দ্রুত কমিয়ে আনা যায় চাকা লক না করেই। এর ফলে টায়ারের গ্রিপ একদিকে যেমন তার সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত পৌছাতে পারে অন্যদিকে এর ফলে স্টপিং ডিস্টেন্স ও তুলনামুলক অনেক কম হয়। এই সুবিধার কারনে যেকোনো রাস্তাতেই ব্রেকিং এর সময় অনেক ভাল কন্ট্রোল পাবেন। নি:সন্দেহে এই বিষয়টি আপনার কনফিডেন্টের লেভেল অনেক বাড়িয়ে দিবে ।
লিংক: এবিএস ব্রেকিং সিস্টেম
ABS কি ব্রেকিং এর দুরত্ব কমায়?
ব্রেকিং ডিস্টেনশানের কথা যদি বলেন তা আসলে অনেক গুলি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। রোড সারফেস, টায়ার এর গ্রিপ , চাকার ঘুর্নন ইত্যাদি অনেক বিষয়ের উরে নির্ভর করে। এবিএস ব্রেকিং সিস্টেম আসলে স্বল্পতম দূরত্বে বাইক থামানোর জন্য উদ্ভাবিত হয়নি । এর মুল উদ্দেশ্য চাকাকে লক না করে এর ঘুর্নন গতিকে কার্যকর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং টায়ারের গ্রিপকে এর সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে যাওয়া। মজার ব্যাপার হলো এর ফলে আপনা আপনিই আপনার ব্রেকিং ডিসটেন্স কমে আসবে। অর্থাৎ আপনি এই সিস্টেমে স্বল্পতম দুরত্বে বাইক থামাতে সক্ষম হবেন।
কর্নারিং এর সময় ABS ভালো কাজ করে?
টায়ারের গ্রীপ নির্ভর করে রাস্তার সাথে টায়ারের এর সংযোগ কতটুকু সফলভাবে হচ্ছে তার উপরে। কিন্তু কর্নার নেবার সময় ল্যাটারাল শেয়ার ফোর্সের কারনে রাস্তার সাথে চাকার সংযোগ কমে যায়। এই সময় আপনি যদি এবিএস সিস্টেম নিয়ে জোরে ব্রেক করেন তা বিপদের কারন হতে পারে। এবিএস সিস্টেম তখনি পুর্ন মাত্রায় কাজ করে যখন চাকা রাস্তার সঙ্গে সম্পুর্ন সংস্পর্শে থাকে।
Combi-Brake System কি?
আমরা জানি প্রতিটি বাইকেরই ব্রেকিং আলাদা। আসলে বাইকের ওয়েট ডিস্ট্রিবিউশান এর ভিন্নতার কারনেই এটি হয়ে থাকে। এখন বাইককে যদি এমন একটা ডিভাইস দেয়া হয় যা দিয়ে এটি বুঝতে পারবে ঠিক কি পরিমান ওয়েট ব্যালান্স বর্তমানে বাইকে আছে এবং সে অনুযায়ি ঠিক কতটুকু রেজিস্টেন্স সামনে বা পেছনের চাকায় প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ ইমারজেন্সির সময় আপনি যদি ঘাবড়ে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়েও সামনে বা পেছনের ব্রেক চেপে ধরেন তাও ওয়েট ব্যালান্স অনুযায়ি নির্দিষ্ট পরিমান রেসিস্টেন্সি সামনের বা পেছনের চাকায় প্রযুক্ত হবে। এর ফলে একদিকে আপনি যেমন নিশ্চিত মনে বাইক চালাতে পারবেন অন্যদিকে বাইক থেকে আপনি ব্রেকিং এর সর্বোচ্চ টুকু আদায় করে নিতে পারবেন । ফলাফল বুঝতেই পারছেন, বাইক চালানোর সময় আপনি অন্য এক ধরনের কনফিডেন্ট ফিল করবেন । ব্রেকিং জনিত অনিশ্চয়তা আপনার মধ্যে থাকবে না। বাইক চালানোতে আপনার কনফিডেন্ট লেভেল অনেক উপরে থাকবে। Combi-Braking System আবার Linked Braking System(LBS) নামেও পরিচিত।যা পরবর্তিতে আরো পরিমার্জিত ব্রেকিং সিস্টেমকে Dual-Combined Braking System বলা হয়।
Dual-Combined Brake System কি?
ডুয়েল কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেম আসলে কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমেরই আরো পরিশীলিত রুপ। কম্বাইক ব্রেকিং সিস্টেমে আপনাকে একই সাথে দুটি ব্রেকই চেপে ধরতে হয় এবং বাইক তার ব্রেকিং ইন্টিলিজেন্স প্রয়োগ করে ওয়েট ব্যালেন্স বুঝে কোন চাকায় কতটুকু প্রেশার প্রোয়গ করতে হবে তা নির্ধারিত করে। এবং আপনি এর ফলে বাইকের সর্বোচ্চ ব্রেকিং এর সুবিধা পাবেন । কিন্তু ডুয়েল কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেম এ আপনাকে উভয় ব্রেক চাপতে হবে না, যেকোনো একটা ব্রেক চাপলেই কাজ হবে । অর্থাৎ সামনের বা পেছনের যে ব্রেকই আপনি চাপুন বাইক ইন্টিলিজেন্স উভয় চাকাতেই ওয়েট ব্যালান্স বুঝে প্রেসার দিবে।
ইমারজেন্সি মূহুর্তে স্বল্প দুরত্ত্বে বাইক থামানোর জন্য সামনের ও পেছনের উভয় ব্রেকের কার্যকর ব্যবহার গুরুত্ত্বপুর্ন এবং এটি একটা ফান্ডামেন্টাল বিষয়। এই বিষয়ে কোন দ্বিমতের অবকাশই নাই। কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমের মজা হলো সামনে বা পেছনে কতটুকু জোরে চাপ দিবেন তা নিয়ে আলাদা ভাবে ভাবতে হবে না। আপনি আপনার ইচ্ছা মতো চাপ দিবেন বাইকই ঠিক করে নিবে কোন চাকায় কতটুকু রেজিস্টেন্স পাঠাতে হবে। আমরা জানি ডুয়েল কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমে যেকোনো একটা ব্রেক চাপে ধরলেই উভয় ব্রেকের কাজ হয় । বাইক ওয়েট ডিস্ট্রিবিউসান বুঝে সামনের ও পেছনের চাকায় মাপমতো চাপ প্রযোগ করে। এটাতো গেলে ডুয়েল কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমে, কিন্তু আপনি যদি কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমে তাড়াহুড়ায় যেকোনো একটা ব্রেক চেপে ধরেন তবে কি হবে? ভয় পাবেন না, এক্ষেত্রেও বাইকের ইন্টারলিঙ্কড এপ্লিকেশনের মাধ্যমে উভয় চাকাতেই আনুপাতিক হারে চাপ দিবে। এক্ষেত্রে সামান্য যে পার্থক্য আছে (DCBS) তা হোল আপনি যদি শুধু সামনের ব্রেক চেপে ধরেন তখন বাইক তার ব্রেকিং সিস্টেমের মুল প্রেসার সামনে দিলেও যাতে বাইক নিয়ে হড়কে না যান সেজন্য পেছনের চাকাতেও নির্দিষ্ট অনুপাতের প্রেসার প্রয়োগ করবে। তবে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে চাইলে আপনি একইসাথে সামনের ও পেছনের ব্রেক চেপে ধরুন ইচ্ছা মতো। বাইক নিজেই বাকি কাজটুকু সেরে নিবে।
CBS এ কি ব্রেকিং দুরত্ব কমে?
আসলে বাইকের ব্রেকিং সিস্টেমের কার্যকরিতা অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে। যেমন বাইকারের অভিজ্ঞতা, রাস্তার অবস্থা, গতি, কি পরিমান ভার বহন করছেন, চাকার প্রেসার ইত্যাদি অনেক বিষ্যের উপরে। কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেম এ যেহেতু উভয় চাকার ব্রেকিং এর একটা সমন্বয় থাকে তাই আপনি আলাদ একধরনের কনফিডেন্স আর রিলাক্স ভাব নিয়ে বাইক চালাতে পারবেন। আসলে স্বল্পতম দূরত্ত্বে বাইক থামানোর চাইতে কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমে গুরুত্ত্ব দেয়া হয় ব্রেকিং কে সহজ করে তোলা অভিজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ উভয় রাইডারের জন্যই। তাই আপনার বাইক পরিস্থিতি উপরে নির্ভর (গতি, ওজন, রাস্তার অবস্থা, ইত্যাদি) করে যে দুরত্ত্বে থামার কথা সে দুরত্ত্বেই থামবে এই সিস্টেম শুধু আপনাকে তা করতে সাহায্য করবে আত্ত্ববিশ্বাসের সাথে সহজে। মুল কথা কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেমের দ্বারা আপনি বাইককে তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে স্বল্পতম দূরত্বে থামাতে পারবেন না।
C-ABS
২০০৯ সালে হোন্ডা C-ABS নামে নতুন একটা ব্রেকিং প্রযুক্তি তাদের CBR1000RR Fireblade মডেলে সংযোজন করে। এটি আসলে CBS আর ABS কে একটা ইলেক্ট্রনিক সার্কিটের মাধ্যমে সংযুক্ত করা। কম্বাইন ব্রেকিং সিস্টেম সাধারন ড্রাম বা ডিস্ক ব্রেক দিয়েও হতে পারে কিন্তু এই ক্ষেত্রে এন্টি লক কে কম্বাইন ব্রেকিং এর সাথে যুক্ত করা। এর ফলে ABS সিস্টেম আরো নিখুত ভাবে ব্যবহারের সুযোগ আপনি পাবেন। ব্রেকিং এ যেমন আপনি যেকোন ব্রেকই ব্যবহার করতে পারছেন একই সাথে চাকা লক হবার সুযোগও থাকছে না। ফলে আপনার ব্রেকিং হচ্ছে আরো নিরাপদ এবং শক্তিশালী।
পরিশেষে
বাইকে এক্সিলারেটর ঘুরালেই গতি বাড়ে কিন্তু ব্রেক চেপে ধরলেই বাইক থেমে যায় না, শুরু হয় নানান হিসেব নিকেশ। এভাবে ব্রেক করলে আছাড় খাবেন, ওভাবে ব্রেক করলে উল্টে যাবেন আরো কত কি। কাজেই বাইক গতি তোলা নয় বরং গতিযুক্ত বাইককে থামানোর জন্য অনেক কসরত বা চেষ্টা করতে হয়। প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবনে ব্রেকিং সিস্টেম উন্নত হচ্ছে। নিরাপদ হচ্ছে ব্রেকিং সিস্টেম।