মোটরসাইকেলের ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম এর সুবিধা ও অসুবিধা
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র কয়েকবছর আগেই আমাদের দেশে মোবাইলফোন বলতে বাটনযুক্ত ফীচার ফোনই ব্যবহার হতো। এরপরে এলো টাচফোন এবং তারপরে স্মার্টফোন। ফীচারফোন এ কল করা, এসএমএস আর কিছু গেম ছিলো। বর্তমানে স্মার্টফোন দিয়ে কি কি করা যায় তার লিস্ট করার থেকে কি কি করা যায় না তার লিস্ট ছোট এবং সহজ। সময়ের প্রয়োজনে মোটরসাইকেলেও ইলেক্ট্রনিক্স এবং আধুনিক সুবিধা যুক্ত হচ্ছে। কিক স্টার্টের পাশাপাশি ইলেক্ট্রিক স্টার্ট, সাধারন বাল্বের পরে এসেছে এলইডি বাল্ব, টিউব টায়ারের পরে টিউবলেস টায়ার এবং এরকম আরো অনেক কিছু। সময়ের প্রয়োজনে এবং অধিক সুবিধার জন্যই নতুনের আগমন। নতুন প্রযুক্তির আগমনে কখনও মনে হয় পুরাতনটিই ভালো ছিলো, কিন্তু নতুনে অভ্যস্থ হবার পরে বোঝা যায় নতুনটির সুবিধা কত। যেমন পুরাতন বাটনওয়ালা ফীচার ফোন ব্যবহার করে কিছু সুবিধা হয়তো আছে কিন্তু বর্তমানের স্মার্টফোন আপনাকে সুবিধার বন্যা বইয়ে দিয়েছে। তাই নতুন প্রযুক্তি সাধারনভাবেই ভালোর জন্যই। যদিও শুরুতে হয়তো কিছু খরচ বেশি হয়ে থাকে, কিন্তু আস্তে আস্তে বিষয়টি সহনীয় হয়ে আসে, দাম এবং অভ্যাস উভয়দিকেই। ১৯৮০ সালের দিকে সর্বপ্রথম মোটরসাইকেলে ইলেক্ট্রনিক্স FI সিস্টেম ব্যবহার হওয়া শুরু হয়। এটি মোটরসাইকেল জগতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন বলা যেতে পারে। ইলেক্ট্রনিক্স প্রসেসর নিয়ন্ত্রিত সিস্টেমটি জ্বালানির সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করে।
ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম কি?
ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেমটি মুলত কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত একটি অংশ যা মোটরসাইকেলের অবস্থান, গতি, তাপমাত্রা ইত্যাদির অবস্থা বিবেচনা করে ইনজিনে প্রয়োজনীয় সঠিক মাপের শক্তি যোগানের স্বার্থে ইনজিনে জ্বালানি তেলের প্রবাহ নিশ্চিতা করা। এই সিস্টেমে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ব্রেইন বা প্রসেসর ব্যবহার করা হয় যাকে ECU (Electronic Control Unit) বলে। যার সংগে যুক্ত থাকে একাধিক সেন্সর। যারা মোটরসাইকেলের বিভিন্ন অংশের অবস্থানগত তথ্য ECU এর কাছে পাঠায়। ECU সেন্সরগুলোর পাঠানো তথ্য বিচার করে সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ইনজিনে কি পরিমান জ্বালানির জোগান প্রয়োজন, এবং সেই পরিমান জ্বালানি দিতে Fuel Injector কে নির্দেশ প্রদান করে।
FI system এর সেন্সরসমুহ
ইলেক্ট্রনিক্স FI সিস্টেমে অনেকগুলো সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। সেন্সরগুলোই মুলত FI সিস্টেমকে সাহায্য করে সিদ্ধান্ত নিতে। কতটুকু তেল ইনজিনে দিবে।
Oxygen sensor: এই সেন্সরটি ইনজিনের combustion চেম্বার এ অক্সিজেনের মাত্রা পরিক্ষা করে প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন সাপ্লাই নিশ্চিত করে।
Throttle position sensor: চালকের চাহিদা অনুযায়ী থ্রটলের পজিশন নির্ধারন করে সেই পরিমান ইনজিনে শক্তি জোগানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিতে এই সেন্সরটি কাজ করে থাকে।
Air temperature sensor: এই সেন্সরটি বাতাসের তাপমাত্রা পরিমাপ করে সেই অনুযায়ী ইনজিনে বাতাস প্রবিষ্ট করে। যেমন শীতে গরমের তুলনাতে ইনজিনে বেশি শক্তির প্রয়োজন।
Speed sensor: এই সেন্সরটি স্পীডোমিটার বা গিয়ারবক্সের সাথে যুক্ত থাকে। এটি মুলত মোটরাসাইকেলের স্পীডের অবস্থা নির্দেশ করে, এবং সেই অনুযায়ী ECU কে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
Oil temperature sensor: এই সেন্সরটি ইনজিনে অবস্থিত ইনজিন অয়েলের তাপমাত্রা পরিমাপ করে ইনজিনের অবস্থা নির্দেশ করে।
Lean angle sensor: এই সেন্সরটি বাইকের কর্নারিং এর সময় বেশি কার্যকর। বিশেষকরে স্পোর্টস বাইকের জন্য এই সেন্সরটি বেশি প্রয়োজনীয়। বাইকটি কি পরিমান কাত বা বাকা হয়ে আছে তা নির্ধারন করে সেই অনুযায়ী সঠিক পরিমান জ্বালানি ইনজিনে দেয়া হয়। সাধারন কার্বুরেটর যেটি করতে পারতো না।
এগুলো মুলত ইলেক্ট্রনিক ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেমের প্রধান সেন্সর। ECU(electronic control unit) এই সকল সেন্সরের দেয়া ডেটা বা তথ্য বিশ্লেষন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ইনজিনে কি পরিমান জ্বালানির জোগান প্রয়োজন।
ফুয়েল ম্যাপ (Fuel Maps)
ফুয়েল ম্যাপ হলো একধরনের পূর্বনির্ধারিত(Preset) প্রোগ্রাম। যার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় বাইকে কি পরিমান জ্বালানি তেলের খরচ হবে। অনেক স্পোর্টস বাইকে এই ধরনের Preset Mode দেখা যায় যেটি আবার পছন্দমতো এডজাস্ট করাও যায়, যেখানে কয়েক ধরনের রাইডিং মোড দেখা দেয়া যায়, যেমন ইকো, নরমাল এবং স্পোর্টস।বাইকারের সেট করা Mode অনুযায়ী ECU বাইকে EFI দ্বারা ইনজিনে প্রয়োজনীয় জ্বালানি পাঠায়।
Eco mode টি মুলত কম জ্বালানি খরচের জন্যই ব্যবহার করা হয়, যেখানে বাইকের গতি মুখ্য বিষয় নয়। Sports Mode এ বাইকের পারফরমেন্স/গতি হলো প্রথম কথা, এরপরে অন্য বিষয়, কাজেই এখানে জ্বালানি খরচ বেশি হতেই পারে। Standard বা Normal Mode এ বাইকের ইনজিন পরিমিত এবং সামান্জস্যপূর্ন পারফরমেন্স করে থাকে, সেভাবেই বাইকারের প্রয়োজনানুসারে জ্বালানি পাঠানো হয় ইনজিনে।
ফুয়েল ম্যা্পে ব্যবহৃত মোড গুলো সব সময় এক রকম হয় না। বাইকের ধরন এবং প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী হয়ে থাকে। অনেক সময় এই ফুয়েল ম্যাপিং আলাদাভাবে প্রোগ্রাম করেও নেয়া যায়। মাথায় রাখতে হবে ভূলভাবে প্রোগ্রাম করা ফুয়েল ম্যাপ বাইকের ইনজিনের ক্ষতি করতে পারে।
Electronic control unit (ECU)
এটি মানুষের ব্রেইন বা কম্পিউটারের সাথে তুলণীয়। মোটরসাইকেলের বিভিন্নস্থানে রক্ষিত বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত সেন্সরগুলোর পাঠানো ডেটা বা তথ্য উপাত্ত বিচার করে ইনজিনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগান দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এই অংশটি। এটি একটি জটিল ইলেক্ট্রনিক্স অংশ। এই অংশ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফুয়েল ইনজেক্টরকে নির্দেশ প্রদান করে ইনজিনে প্রয়োজনীয় জ্বালানী তেলের জোগান দিতে।
ফুয়েল ইনজেকশন এর সুবিধা
- সব সময় একইপরিমান শক্তির যোগান
- জ্বালানি তেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার
- ঠান্ডায় সহজেই স্টার্ট
- নিখুত থ্রটল রেসপন্স
- বেশি মাইলেজ
- রাইডিং মোড অনুযায়ী জ্বালানি খরচের সুবিধা
ফুয়েল ইনজেকশন এর অসুবিধা
- মেইনটেনেন্স খরচ বেশি
- বাইকের দাম বেশি
- জ্বালানি তেলের সর্বশেষবিন্দু পর্যন্ত ব্যবহারের সুযোগ নেই
শেষ কথা
সময়ের সাথে প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন সুবিধাযুক্ত্ যন্ত্র আবিস্কৃত হচ্ছে। FI সিস্টেমটি নতুন বিধায় হয়তো খরচ কিছুটা বেশি কিন্তু সময়ে প্রেক্ষিতে এটি সকল মোটরসাইকেলেই ব্যবহৃত হবে এটি সুনিশ্চিত। আর তখন বিষয়টি যেমন সহজ হবে, খরচও কমে আসবে।