একজন প্রকৃত বাইকারের আচরন
উনবিংশ শতাব্দী তে যোগাযোগ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি সময়ে সেই উদ্ভাবন যোগাযোগের এক অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠে। হ্যাঁ প্রিয় বন্ধুরা, আমি মোটরসাইকেল বা দ্বিচক্রযানের কথা বলছি, যার আকর্ষণীয় ডিজাইন, সহজ যোগাযোগের মাধ্যম এবং স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বব্যাপী অনেক জনপ্রিয়।বেশিরভাগ মানুষের কাছে মোটরসাইকেল একটি প্রয়োজনীয় বাহন আবার কিছু ব্যক্তি বা গ্রুপের কাছে এটি আবেগ এবং বিনোদনের মাধ্যম । তারা দেশে এবং দেশের বাইরে লং ড্রাইভে যান এবং হৃদয় রোমাঞ্চকর কিছু করার প্রচেষ্টা করেন যা আমাদের কাছে স্টান্ট হিসেবে পরিচিত। বাইকাররা বিশ্বাস করেন যে ‘চার চাকা বহন করে শরীর আর দুই চাকা বহন করে হৃদয়’। কিছু কিছু সময় এই গভীর ভাবাবেগ বাইকার কে সমাজে দুর্জন হিসেবেও তুলে ধরে।
১৯৪৭ সাল এর পর থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যখন বাইকার গ্রুপ গঠিত হয় ঠিক তখন থেকেই বাইকারদের প্রতি এই ধরণের খারাপ ধারনা পোষন করে আসছে। কিছু যুবকের দল যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসে এবং তারা তাদের জীবনে কিছু মনোরঞ্জকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চায়। তারা তরুণ ছিল, সাহসী ছিল, তারা নিজেদেরকে বিপদের কাছে অপরাজেয় ভেবে সামনের দিকে অগ্রসর হতো ।তারা ভাল সময় খোঁজার জন্য মোটরসাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াতো। সম্ভবত তারা তাদের খারাপ স্মৃতি গুলোকে মুছে ফেলার একটা দিক খুঁজতো। প্রায়শই অন্তরের গভীর থেকে পুরোনো স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করতো। একদিন তারা একটি ছোট শহরে মোটরসাইকেল র্যা লীর আয়োজন করেন কিন্তু সেই ছোট র্যা লীটি ছোট শহরে অনেক বিরাট আকার ধারণ করে।একটি বড় মাদকাসক্ত গ্রুপ তাদের র্যা লী কে পন্ড করেছিলো এবং পরদিন পেপারে শিরোনাম আকারে প্রকাশ করা হয় এবং বাইকারদের সারা বিশ্বে গুন্ডা হিসেবে তুলে ধরা হয়।
সময় পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ এখন জানে মোটরসাইকেল এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে, কিন্তু এখনও একজন বাইকার হিসেবে আমাদের মনোভাব আরও উন্নত হওয়া প্রয়োজন। একজন নাগরিক হিসেবে রাস্তা এবং হাইওয়ের নিয়ম –কানুন মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাইকারদের অবশ্যই অনুসরণ করা উচিত নিজের এবং সমাজের কল্যাণের জন্য । কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেগুলো দ্বারা একজন বাইকার তার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর দিকে সচেতন হতে পারে তা নিম্নে দেওয়া হলঃ
নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন থাকা
‘নিরাপত্তা সবার আগে’ এটা একটা চিরন্তন সত্য প্রবাদ বাক্য যেটা শুধু বাইকারদের ক্ষেত্রে না সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমাদের সবার মোটরসাইকেল গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কিমি স্পীডে চলে যেটা সামান্যতম ভারসাম্য হারালেই আমাদের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। তাই রাইডারদের উচিত হেলমেট এবং জুতা পরিধান করে বাইক চালানো। তবে হ্যান্ড গ্লোভস, হাটু এবং কুনই প্রটেকশন থাকলে আরও ভাল হয়।
“দুই চাকায় বাংলাদেশ” এর প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আহমেদ এর মতে- “একজন বাইকারকে অবশ্যই স্বদেশপ্রেমী হতে হবে পাশাপাশি নিজের এবং অন্যের নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখতে হবে। তাই বাইকারদের উচিত অন্যান্যদের নিরাপত্তার বিষয় অনুধাবন করানো সেই সাথে একজন প্রকৃত বাইকার হিসেবে উচিত মোটরাইকেল এর যাবতীয় কাগজপত্র সমূহ সংগে রাখা।”
নিয়মকানুন মেনে চলা
রাস্তায় দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য এবং নিরাপদ করার জন্য সরকার কিছু নিয়মকানুন বেধে দিয়েছেন। দেশ ভেদে আইন কানুন ভিন্ন হতে পারে তবে অভিপ্রায় সকল দেশের জন্য একই। এর কারণ হল দেশের রাস্তা গুলোতে চালকদের জন্য নিরাপত্তা বিধান করা।আমাদের দেশে, মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোটরসাইকেল রেজিসট্রেশনের বৈধ কাগজপত্র, এবং হালনাগাদ করা ইন্সুরেন্স কাগজ পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। অধিকন্তু, রাস্তার বিভিন্ন নিয়মকানুন মেনে চলা প্রয়োজন যেমন রোড লাইট, রাস্তার পাশে থাকা নির্দেশনা এবং রোড লাইন ও রোড ক্রসিং নিয়ম ইত্যাদি। উদ্বেগ এর বিষয় হল এই যে,বর্তমানে অনেক রাইডারগণ নিয়ম কানুন ভেঙ্গে বাইক চালাচ্ছে যা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ট্র্যাফিক আইন মেনে নিয়ে নিরাপদে চলাচল করা এবং অন্যকেউ নিরাপদে চলাচল করার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য রাইডিং দম্পতি আলমগীর আহমেদ চৌধুরী এবং চৌধুরানী দিপালী আহমেদ বলেন – ‘একজন প্রকৃত বাইকারের মোটরসাইকেলের সকল কাগজপত্র থাকা প্রয়োজন যেটা একজন নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।তারা জোরালো কন্ঠে ব্যক্ত করেন যে, যারা স্পীডের কথা মাথায় রেখে বাইক চালায় তারা প্রকৃত রাইডার নন, তারা রেসার। প্রকৃত বাইকার তারাই যারা তাদের বাইকের স্পীড ৭০ কিমি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং তারা কখনই রাস্তার যেখানে সেখানে অযথা ইউ টার্ন নেন না’।
ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্ঠি
এটি স্পষ্ট ভাবে বলা যেতে পারে যে ভ্রমনের ক্ষেত্রে অন্যান্যদের মত আপনিও কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। একজন বাইকার হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব হল অন্য রাইডারদেরকে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং যতদূর সম্ভব তাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা।অন্যকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে নিজেকে সচেতন থাকা প্রয়োজন, কারণ কিছু দুর্বৃত্ত শ্রেণীর মানুষ মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে অসংখ্য মোটরসাইকেল গ্রুপ বিদ্যমান আছে যাদের কাছ থেকে বাইকারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করার ধারনা পাওয়া যায়।
বাইকারদের মধ্যে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে The Survivor গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মো: রেজাউল করিম সবুজ বলেন- “একজন বাইকার সর্বপ্রথম একজন প্রকৃত মানুষ হবেন। সবার উপরে মনুষত্বের পরিচয় দিবেন। রাস্তায় চলতি পথে অপর বাইকারের বিপদে এগিয়ে আসবেন। ব্যক্তি এবং গ্রুপের উর্ধ্বে থেকে বাইক কমিউনিটির স্বার্থ সবার আগে দেখবেন। বাইকের দাম/ব্রান্ড/সিসি ইত্যাদি সংক্রান্ত ইস্যুকে কেন্দ্র করে পারস্পারিক কাদা ছোড়াছুড়ি করা কখনই শোভন নয়। বাইক কমিউনিটির স্বার্থেই সবাই একত্রে কাজ করতে হবে।”
লং রাইডে করনীয়
বর্তমানে লং ড্রাইভ অনেক বাইকারের কাছে প্যাশন এবং ফ্যাশান এর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।তারা শুধু দেশেই লং ড্রাইভে বের হয়না মাঝে মাঝে তারা দেশের সীমানা পেরিয়ে দেশের বাইরেও লং ড্রাইভে যায়। লং ড্রাইভ সার্থক করার জন্য দরকার ভাল পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সেই সাথে সাথে প্রয়োজন দ্রুত সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষমতা। যদিও ভবিষতে কি হতে চলেছে সেই সম্পর্কে আমরা কেউ জানি না তবে এই ধরনের মানসিকতা কিছুটা হলেও সহায়ক হতে পারে। দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বাইকারদের অবশ্যই সঠিকভাবে ড্রেস আপ করা প্রয়োজন। সেই সাথে বাইকের পেছনে ব্যাগ রাখার জন্য র্যা ক লাগানো, প্রয়োজনীয় সব কিছু ভাল ভাবে প্যাক করা, অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্র বাদ দেওয়া এবং যতটূকু সম্ভব নিজের আয়ত্বের মধ্যেই রাইড করা।
লিংকটি দেশের বাইরে মোটরসাইকেল ভ্রমন প্রেমিকদের জন্য সহায়ক হবে-
Click Here
বাংলাদেশের অন্যতম একজন লং রাইডার সাদিকুল্লাহ জুন এর মতানুসারে – “ট্যুর করার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রস্তুতি। সেই সাথে মোটরসাইকেল এর প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকা দরকার এবং মোটরসাইকেলটি যাত্রা শুরুর দুই/তিন দিন আগে সার্ভিসিং করিয়ে নেওয়া দরকার।এতে করে ভাল পারফর্মেন্স পাওয়া যায়। বাইকার কে আবশ্যক কাগজপত্র সাথে নিতে হবে এবং নিজ গন্তব্যের জায়গার মানুষ তাদের কালচার কে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এর কারণ হল আপনি শুধু নিজেই নিজেকে তুলে ধরছেন না আপনি আপনার সমগ্র সমাজ এবং দেশ কে তুলে ধরছেন।“
মোটরসাইকেল স্টান্ট
স্টান্ট এই শব্দটি অনেক তরুণদের কাছে খুব আকর্ষণীয় একটি শব্দ। আমাদের দেশে ভিন্ন ভিন্ন স্টান্ট রাইডার গ্রুপ দেখা যায় যারা প্রফেশনালি এবং মাঝেমাঝে আমাদের স্টান্ট শো উপহার দিয়ে থাকে।এই হৃদয় রোমাঞ্চকর খেলা মাঝে মাঝে রাইডার এবং দর্শকদের জন্য বিপদজ্জনক হয়ে উঠে। সাধারণত আমাদের দেশে স্টাণ্ট শো কে ভালভাবে গ্রহন করা হয় না। তাই স্টান্ট রাইডার দের কিছু বিষয় অবশ্যই মান্য করা উচিত। প্রথমে যে বিষয়টি আসে সেটি হল, সেফটি গিয়ার। যেটা বাইকারকে অপ্রত্যাশিত কিছু মুহূর্ত গুলো থেকে রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত, স্টান্ট ভালভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্ধারিত সময় এবং স্থান এই দুটি বিষয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যেন সমাজের মানুষের নিকট ঝামেলাবিহীন মনে হয়। স্টান্ট রাইডার দের অবশ্যই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নেওয়া এবং ট্র্যাফিক আইন মেনে চলা উচিত।
এ ব্যাপারে রাজশাহী স্টান্ট রাইডার গ্রুপের ফাউন্ডার মেম্বর এম, এ হানিফ জিসান বলেন- ‘ভাল চর্চা থাকা এবং সম্পূর্ণ গিয়ারস সঙ্গে থাকলে নিরাপদ থাকা যায়। তিনি আরও বলেন, সবার উচিত ট্র্যাফিক আইন মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে রাখা। সবচেয়ে বড় কথা হল সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে এবং ভাল মানুষ হতে হবে’।
বাইকার শুধু মাত্র একটি শব্দ না। এই শব্দটি একটি গ্রুপের পরিচয় বহন করে। তাই মোটরসাইকেল রাইডারদের ইতিবাচক মনোভাব থাকা প্রয়োজন।যেন প্রত্যেকে
BIKER কে ব্যাখ্যা করে “
BUDDY
IS
KNOWN AS
EFFICENT
RIDER”.