বাংলাদেশের রাস্তায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণসমূহ এবং প্রতিকারের উপায়
আমাদের দেশের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা নিত্য দিনের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । সরকারের নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহন সত্ত্বেও বাইক এক্সিডেন্ট যেন কমেই না দিন দিন বাইক এক্সিডেন্টের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে পঙ্গুত্ব ও স্বজনদের আহাজারি। আমরা টিম মোটরসাইকেল ভ্যালী কয়েকজন অভিজ্ঞ ওঁ যারা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন এমন রাইডারদের সাথে কথা বলে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ সমূহ চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি যা আপনাদের সামনে নিম্নে তুলে ধরা হল ।
রাস্তা নিরাপদ না হওয়া
বাইক এক্সিডেন্টের প্রধান ও অন্যতম কারণ হল রাস্তা নিরাপদ না থাকা। আপনি যে রাস্তা দিয়ে বাইক রাইড করছেন সেটি ভাঙ্গা কি/না , রাস্তার জায়গা চলাচলের জন্য ঠিক আছে কী/ না, রাস্তায় মানুষ, যানবাহন, গৃহপালিত পশুপাখি কেমন চলাচলে করে সেগুলো সম্পর্কে আপনাকে অবগত থাকতে হবে। যদি অপরিচিত কোন রাস্তায় রাইড করেন তাহলে খেয়াল করে দেখবেন সেই রাস্তায় পরিবেশের সাথে আপনি মানাতে পারছেন না । যে কোন মানুষ , যানবাহন , গবাদি পশু ইত্যাদি আপনাদের সামনে হটাত করেই চলে আসছে। এজন্য আমরা বলে থাকি যে অপরিচিত রাস্তায় নিরাপদ স্পীড রেখে রাইড করার জন্য। আমাদের দেশের হাইওয়ে কিংবা লোকাল ওয়ে কোনটাই শতভাগ নিরাপদ না কারণ হাইওয়েতে বেপরোয়া গতি এবং শহরের বা লোকাল রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে রিক্সা, অটো ইত্যাদি চলাচল করে।সড়কে অনিরাপদ চলাচলের জন্য বর্তমানে বেশি এক্সিডেন্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে আপনি যদি বাইক রাইড সবে মাত্র শিখছেন এবং রাস্তায় নেমেছেন সেক্ষেত্রে আপনাকে আশেপাশের যানবাহন, মানুষ, পশুপাখী ইত্যাদির উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তাদের অনিরাপদ চলাচলের জন্য আপনার এক্সিডেন্ট হতে পারে। আপনি যতই সতর্কতা অবলম্বন করুন না কেন অন্য কেউ এসে যদি আপনাকে স্বজরে ধাক্কা দেয় তাহলে আপনার ক্ষতি হতে সময় লাগবে না।
বেপরোয়া গতি
বেপরোয়া গতি বাইক এক্সিডেন্টের জন্য বড় একটি কারণ। আমাদের দেশে মোটরসাইকেলের সর্বচ্চো সিসি হচ্ছে ১৬৫ সিসি কিন্তু এই ১৬৫ সিসির মধ্যে কিছু প্রিমিয়াম বাইক আছে যাদের গতি অনেক বেশি। আমরা অবশ্যই বলবো যে বাইকের গতির প্রয়োজন আছে কিন্তু সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আপনি যদি সরু রাস্তায় বাইক ওভার স্পীডে রাইড করেন তাহলে আপনার সবচেয়ে বড় বোকামি । অন্যদিকে রাস্তায় পথাচারী থাকবে এবং তাদের অবহেলাও থাকবে । এই সমস্ত বিষয় মাথায় নিয়ে আপনাকে রাস্তাভেদে স্পীডিং করতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু এক্সপ্রেক্স হাইওয়েতে আছে যেটা স্পীডিং করার জন্য উপযুক্ত কিন্তু সেখানেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কারণ আমাদের দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি যার ফলে যে কেউ যে কোন মুহূর্তেই রাস্তা পারাপার হবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার । এই সমস্ত বিষয় মাথায় নিয়েই আপনাকে রাইড করতে হবে। না বুঝে বেপরোয়া গতিতে রাইড করলে এক্সিডেন্টের শঙ্কা বেশি থাকে।
রাস্তায় অন্যান্য অদক্ষ ড্রাইভার
আমাদের দেশে দিন যত যাচ্ছে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যটাও অনেক বাড়ছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে অধিকাংশ ড্রাইভারের অদক্ষভাবে রাস্তায় রাইড করছে এবং অন্যান্যদের জীবনের ঝুকি বাড়ছে । এই দিক থেকেও বাইক রাইডারদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কারণ বাইক হচ্ছে রাস্তার সবচেয়ে ছোট বাহন এবং বড় বড় যানবাহন বাইককে তোয়াক্কা করে না ওঁ সাইড দেয় না। অদক্ষ ড্রাইভাররা বুঝে না যে তার কতটুকু জায়গার প্রয়োজন এজন্য সে প্রয়োজনের অধিক জায়গা নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে। অনেক সময় দেখা যায় যে আমাদের মোটরসাইকেল অধিক স্পীডে আছে এবং বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন চাপ দিয়ে বা রাস্তায় অধিক জায়গা নিয়ে সামনের দিকে আসে এবং বাইক চলাচলের জন্য জায়গা থাকে না। সেজন্য বাইকের রাইডের ক্ষেত্রে এই অদক্ষ ড্রাইভারের বিষয়টিও মাথায় রেখে রাস্তায় রাইড করতে হবে।
হেলমেট ও সেফটি গিয়ারস পরিধান না করা
হেলমেট একটি বাইকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন সেফটি ফিচারস কারণ এটি আমাদের মাথাকে আঘাত থেকে রক্ষা করে। আমরা যারা বাইক চালায় তাদের অবশ্যই উচিত বাইক কেনার আগে ভালো মানের সার্টিফাইড হেলমেট কেনা। হেলমেট পরিধান না করে বাইক এক্সিডেন্ট করলে আপনি বড় সমস্যার সম্মুখীন হবেন এবং সেই এক্সিডেন্ট আপনার জীবনের হুমকি স্বরূপ হতে পারে। আমাদের দেশের রাস্তায় লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে হেলমেট ছাড়া বাইক চালানো একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। অনেকেই হেলমেট পড়তে অনীহা করেন।
অন্যদিকে সেফটি গিয়ারস পড়ে বাইক রাইড করলে আপনি যদি সামান্য আঘাত পান তাহলে সেটা সেফটি গিয়ারস অনেকটাই নির্মুল করবে এবং আপনি হয়তো বড় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবেন । বড় কোন দুর্ঘটনা হলে সেখানে সেফটি গিয়ারসের কিছু করার থাকে না তখন সেটা সম্পূর্ণ আপনার ভাগ্যের ব্যাপার । তবে হেলমেট ও সেফটি গিয়ারস পড়লে আপনার রাইডিং মনোযোগ এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আমাদের দেশের রাস্তায় এই সেফটি গিয়ার ও হেলমেটের ব্যবহার না তেমন লক্ষনীয় না হওয়ার কারণে বাইক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ প্রান হারায় এবং পঙ্গুত্ব লাভ করে।
অতিরিক্ত ওভারটেকিং ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা
অতিরিক্ত ওভারটেকিং ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমরা হরহামেশাই লক্ষ্য করি। কার বাইকের টপ স্পীড কত? কার বাইক আগে যাবে ইত্যাদি নানা বিষয় যখন মাথায় নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় অনেক বাইকার। আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে লক্ষ্য করলে দেখতে পারি যে বাইকের টপ স্পীড এবং কে কার আগে যেতে পারে সেটা নিয়ে অনেক মাতামাতি করা হয় এবং ভিডিও আপলোড করা হয় । এসব দেখে আরেকজন চেষ্টা করে তার বাইকের সাথে সেটা করার। এটা করা একদম ভুল, কারণ যার ভিডিও দেখে আপনি নিজেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন খেয়াল করে দেখবেন সে সেই বিষয়ে অনেক পারদর্শী কাজেই আপনাকে সর্বদা চেষ্টা করতে হবে যে আপনার আওতায় রেখে বাইক ওভারটেকিং কিংবা প্রতিযোগিতা করা । আমাদের মতে ওভারটেকিং ও প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় কারণ আমাদের দেশের রাস্তাগুলো এখনও প্রতিযোগিতা করা কিংবা অতিরিক্ত ওভারটেকিং করার জন্য উপযুক্ত নয়।
বাইক এক্সিডেন্ট থেকে প্রতিকারের উপায় সমূহ
আমরা উপরিউক্ত অংশে আলোচনা করলাম কী কী কারণে সাধারণত বাইক এক্সিডেন্টগুলো হয়ে থাকে। এবার আমরা আলোচনা করবো এই এক্সিডেন্ট থেকে প্রতিকারের উপায়।
-আপনাকে অবশ্যই হেলমেট ও সেফটি গিয়ার পরিধান করে বাইক রাইড করতে হবে। যদি সম্ভব হয় বাজার থেকে ভালো মানের সার্টিফাইড হেলমেড ও সেফটি গিয়ার কিনুন কারণ এগুলোর নিরাপত্তা ফিচারস অনেক বেশি ।
-নিজের আওতায় রেখে বাইক রাইড করুন। অপরিচিত ফাঁকা রাস্তায় ভুল করেও বাইকের ওভার স্পীড করতে যাবেন না।
-সামনে থেকে যে যানবাহন আসছে তার গতিবিধি লক্ষ্য করুন এবং আপনার যতটুকু রাস্তা দরকার সেটা নিয়ে তাকে তার মত সাইড দিন।
-ভোরবেলা বাইক রাইড থেকে সাবধান থাকুন কারণ এই সময় দূর পাল্লার অনেক যানবাহন আসে এবং সেই সব ড্রাইভারদের চোখে অনেক ঘুম থাকা সত্ত্বেও তারা ঘুমাতে পারে না । তাই তারা দ্রুত তার গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করবে এবং আপনাকে লক্ষ্য করবে না এটা স্বাভাবিক ।
-অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকুন। আপনার যদি রাইডিং স্কিল ভালো হয় তাহলে চেষ্টা করুন সব কিছু মেইনটেইন করে প্রতিযোগিতা করার এবং আমাদের পার্শবতী দেশ ভারতের ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হবেন না কারণ তাদের রাস্তার পরিস্থিতি ও আমাদের রাস্তার পরিস্থিতি ভিন্ন।
-গ্রামের রাস্তায় রাইডের সময় খেয়াল করবেন যে আপনার সামনে কোন গবাদি পশু , মানুষ কিংবা রাস্তায় কিছু ফেলা আছে কিনা । অনেক সময় দেখা যায় যে রাস্তায় ধান জাতীয় জিনিস শুকাতে দেওয়া হয়। এসব দেখা মাত্রই আপনার বাইকের গতি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আনুন।
-বৃষ্টির দিনে যে সকল রাস্তায় খানাখন্দ বেশি সে সব রাস্তায় বুঝে শুনে রাইড কারুন । কারণ কোথায় বেশি গর্ত কোথায় কম গর্ত সেটা কিন্তু আপনি জানেন না।
-৪ লেনের রাস্তায় লক্ষ্য রাখবেন উল্টা দিক দিয়ে কোন যানবাহন আসছে কী/না।
সর্বোপরি মহান সৃস্তিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে বাইক রাইড করুন। আশা করা যায় রাস্তার নিয়ম কানুন , নিজের ভালো মন্দ বুঝে বাইক রাইড করলে আপনি নিরাপদে আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন যে আপনি বেশি স্পীডে বাইক রাইড করলে আপনার গন্তব্যে ৫ মিনিট আগে পৌছাবেন আর নিয়ন্ত্রনে রাইড করলে ৫ মিনিট পরে পৌছাবেন নিরাপদে, এটাই পার্থক্য। আমরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি এই বাইরেও অনেক বিষয় আছে সেগুলো মেনে রাইড করবেন। আপনার রাইডিং সুন্দর ও উপভোগ্য হোক এই কামনায় টিম মোটরসাইকেল ভ্যালী।