মোটরসাইকেল সাসপেনশানের ইতিহাস
দুইচাকার শুরুটা বাইসাইকেল দিয়ে। যুগটি ছিল ইন্টারনাল কম্বাশান ইঞ্জিনের (internal combustion engine) । কিছু মানুষ কৌতুহলি হয়ে কম্বাশান ইঞ্জিন বাইসাইকেলে সেট করে দিলেন। অবাক হয়ে দেখলেন বিষয়টি খারাপ হয়নি। এরপরে তারা আরো বড় ইঞ্জিন লাগানোর সাহস করলেন। ফলাফল দেখে তারা মুগ্ধ হলেন। কিন্তু সমস্যায় পড়লেন অন্য জায়গায় । ব্যাটা আরামদায়ক তো নয়ই, বরং যন্ত্রনাদায়ক সাথে বিপদজনকও। রাস্তার ঝাঁকুনিতে হাড় পর্যন্ত নড়িয়ে দিচ্ছে আর কর্নার নেবার সময় আছাড় খেয়ে পড়ে দুই একজনার হাড়ও ভাংছে । কিন্তু এই সমস্যা দূর করতে পারলে সেই সময়ের গতিহীন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার। সময়টা ১৯ শতকের মাঝামাঝি। কিছু সময় এভাবেই গেলো। তারপরে আর একদল মানূষ এগিয়ে এলেন সমস্যার সমাধানে। তারা এমন কিছু যন্ত্রাংশের ডিজাইন করলেন যা এই সমস্যার সমাধান এনে দিলো।
হ্যা বলছিলাম মোটরসাইকেল সাস্পেশান এর ইতিহাস নিয়ে। তার আগে আসুন জেনে নেই মোটরসাইকেলের সাস্পেনশান কাকে বলে এবং এর কাজ কি?
সাসপেনশন কি এবং কেন?
সরল কথায় বলতে গেলে মটরসাইকেলের সামনে ও পেছনে চাকার সাথে যে স্প্রিঙের মতো দুটি যন্ত্রাংশ লাগানো থাকে তাকে সাসপেনশান বা শক এবজরভার বলে। সাস্পেনশানের কাজ বহুবিধ; তারমধ্যে মুল কাজ হলো রাস্তার ঝাঁকুনি থেকে মোটরসাইকেলের চেসিস তথা রাইডারকে সুরক্ষা দেয়া এবং চাকাকে রাস্তার সাথে ভালভাবে সংযুক্ত রাখা। সাসপেনশান খারাপ থাকলে আপনি দ্রুত গতিতে বাইকে ব্রেক করতেই পারবেন না।
আধুনিক বাইক সাসপেনশনে কয়েল স্প্রিং ব্যবহার করে। আমাদের প্রচলিত মোটরসাইকেলে পেছনের সাসপেনশনে এই কয়েলস্প্রিং সহজেই দেখা যায়। সামনের স্প্রিং অধিকাংশ সময়ই ফর্ক টিউবের মধ্যে কনসিল অবস্থায় থাকে। মটরসাইকেলের ধরন বুঝে সাসপেনশন কয়েলের ট্রাভেল বা মোশন নির্ধারন করা হয়। ডার্ট বাইকে সর্বোচ্চ ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত ট্র্যাভেল রেশিও থাকে অন্যদিকে ক্রুজার বাইকে সবচেয়ে কম সাস্পেন্সান ট্রাভেল রেশিও থাকে তিন ইঞ্চির মতো।
আপনার বাইক যদি এই পুরো সাসপেনশন ট্রাভেল রেশিওতেই নিয়মিত মুভ করে তবে একে BOTTOMING বলে। এ ক্ষেত্রে আপনার উচিৎ দ্রুত সাস্পেন্সান বদলে ফেলা। কারণ এতে আপনার বাইকের ব্রেকিং এ মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই বিষয়ে আমাদের আলাদা একটা আর্টিকেল আছে।
ব্রেকিংএ সাসপেনশনের প্রভাব জানতে এখানে ক্লিক করুন
একেবারে প্রথম দিকে বাইকের সামনের সাস্পেসানের অভাব দূর করার জন্য যে ডিজাইন করা হয় তা ছিল Girder Fork । অনেকটা বাইসাইকেলের সামনের চাকার ফর্কের মতো তবে পার্থক্য একটাই দুই ফর্কের মাঝখানে একটা স্প্রিং লাগানো থাকতো । পরবর্তি সময়ে ড্যাম্পার Damper লাগানো হয় কন্ট্রোলের সুবিধার জন্য। বেশ কিছুদিন এই সাস্পেন্সান্স চলে। সর্বশেষ যে বাইকে এই সাস্পেন্সান ব্যবহার করা হয় তা হলো ১৯৫০ এর সুপারবাইক, the Vincent Black Shadow. বাইকটি অনায়েসেই ২০০ কিমি/ ঘন্টা গতি তুলেতে পারতো। কিছু সমস্যার জন্য এই সাস্পেশান পরে আর ব্যবহৃত হয়নি। ওজনে ভারী, তুলনামুলক লম্বা হবার কারণে সেন্টার গ্রাভিটি ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, সবচেয়ে বড় কথা বাইক ডানে বামে খুব বেশী ঘুরানো যায় না। এতো সমস্যা সত্তেও বর্তমানে The Confederate Wraith. বাইকে এই সাস্পেনশান এখন ব্যবহৃত হচ্ছে।
Girder Fork এর নিকট আত্মীয় বলতে পারেন Springer Fork কে। চপার টাইপ বাইকে এর ব্যবহার দেখা যায়। মূলত মাস্কিউলার ভিজুয়াল এপিলের কারনেই চপারে এ ধরনের ফ্রন্ট সাস্পেনশান ব্যবহার করা হয়। ডিজাইনে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও Girder Fork এর সবকয়টি সমস্যাই এতে বর্তমান। তাই আধুনিক বাইকে এর ব্যবহার নাই ।
সময়টা ১৯১৮ সাল। মটরসাইকেলের বয়স তখন কেবল ২০ হয়েছে কি হয়নি। Carl Neracher নামের এক আমিরিকান এমন একটা মোটরসাইকেলের ডিজাইন করলেন যা ছিল সেই সময় থেকে অনেক বছর এগিয়ে। তিনি বাইকটির নাম দিলেন নিয়ার এ কার (Ner-a-Car) । ২২১ সিসির এই বাইকটি ছিল টু স্ট্রোক, monocoque chassis এর বাইকটির স্টিয়ারিং ছিল পেটের কাছে। মাত্র ৬ বছরে তিনি আমেরিকা এবং ইউরোপে ১৭ হাজার বাইক বিক্রি করেন। বাইকটি স্ট্যাবিলিটির জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত বাইটিতে কোন পেছনের সাস্পেনশান ছিল না। তবে সামনের চাকায় Sprung swinging arm সাপেনশান বাইকটিকে নতুন মাত্রা এনে দেয়। Carl Neracher ই প্রথম প্রথাগত ফ্রন্ট সাস্পেন্সানের ধারনা পালটে দেন তার বাইকের সামনের চাকায় সুইং আর্ম সাস্পেনশান ব্যবহার করে। ওজনে হালকা , কনট্রলে সুবিধা, সরাসরি হ্যান্ডেলের সাথে যুক্ত না থাকায় প্রায় ঝাঁকুনি বিহিন । এর অনেক পরে ১৯৬০ সালে SUZUKI সামনের চাকায় সুইং আর্ম সাস্পেন্সান ব্যবহার করে তাদের Suzuki GT550 মডেলে। জনপ্রিয়তা পায় বাইকটি।
সামনের চাকায় সুইং আর্ম সাস্পেন্সান ব্যবহারের সুবিধা হলো এতে করে, ব্রেকিং এবং স্টিয়ারিংকে সাস্পেনশান থেকে আলাদা করা যায়। ফলে বাইক অনেক জোরে চালানো যায়। পরবর্তিতে হোন্ডা, ইয়ামাহার মতো ব্রান্ডও তাদের রেসিং বাইকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় ৯০ ভাগ মোটরসাইকেলেই সামনে টেলিস্কোপিক ফর্ক সাস্পেন্সান ব্যবহার করে থাকে। নিশ্চয় আপনারা টেলিস্কোপ দেখেছেন। দুটি টিউব একটির মধ্যে অন্যটি ঢুকানো, উভয় টিউবেরই শেষ প্রান্তে লেন্স লাগানো। দূরে দেখার ক্ষমতা কম বেশি করার জন্য টেলিস্কোপের শেষ প্রান্ত টেনে বা ভেতরে ঢুকিয়ে এডজাষ্ট করা হয়। মটরসাইকেলের সামনের চাকার টেলিস্কোপিক ফর্ক সাস্পেনশানে একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে একটি প্রাইমারি ব্যারেলের মধ্যে সাবলীল ভাবে মুভমেন্ট করার জন্য একটি স্লাইডার বার ঢুকানো থাকে । শক এভজর্ভ করার জন্য ভেতরে একটি স্প্রিং এবং ফর্ক অয়েল থাকে। টেলিস্কোপিক সাস্পেনশান তিনটি ক্লাম্পের সাহায্য হ্যান্ডেল বারের সাথে ঝুলানো থাকে অপর প্রান্ত চাকার এক্সেলের সাথে যুক্ত থাকে। এর ফলে সমস্ত শক সিস্টেম সামনের চাকার সাথে যুক্ত হয়ে যায় । এতে করে চাকার মুভমেন্ট যেমন চমৎকার ভাবে করা যায় তেমনি বাইককে স্থিতিশীল রাখার জন্য হ্যান্ডেলও যথেষ্ট শক্ত থাকে।
ধারনা করা হয় ১৯৩২ সালের Messerschmitt’s M29 প্লেনের ল্যান্ডিং গিয়ারের সাথে এই সাস্পেনশানের একটি যোগ সুত্র আছে। ১৯৩৪ সালে ডেনিস ভ্যকুয়াম ক্লিনার কোম্পানি Fisker & Nielsen (Nilfisk vacuum cleaner) তাদের নতুন মোটরসাইকেল Nimbus তৈরির সিধান্ত নেয়। এবং তারাই প্রথম টেলিস্কোপিক ফর্ক ব্যবহার করে। এটি ছিল Oil damped telescopic fork। মোটরসাইকেলের সামনের সাস্পেন্সানের জন্য একটি নতুন দুয়ার উম্মচিত হলো। ১৯৩৪ থেকে ১৯৬০ এর মধ্যে ফিস্কার এবং নেলসন ১২০০০ বাইক বিক্রি করে , যার ৪০০০ এখনো সচল। BMW ১৯৩৫ সালে প্রথম তাদের R12 এবং R17 বাইককে টেলিস্কোপিক ফর্ক সাস্পেনশান ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে BMW ব্যবহার করে Hydraulically damped telescopic fork. BMW এই সাস্পেন্সানে এততাই মুগ্ধ হয়েছিল যে সামনের সাস্পেনশান নিয়ে পরবর্তি ২০ বছর তারা আর কোন গবেষনাই করেনি।
টেলিস্কোপিক ফর্ক সাস্পেনশানের একটা বড় অসুবিধা হলো ব্রেক করলে ড্রাইভ দেয়। যা বাইকের স্টাবিলিটি এবং কন্ট্রোলে বড় ধরণের প্রভাব ফেলে । আবার রাস্তায় অতিরিক্ত বাম্প থাকলে এর সেন্সিভিটি কমে যায়। আর একটা সমস্যা হলো সামনের চাকাকে শক্তভাবে ধরে রাখার জন্য স্টিয়ারিং হেডে একটি অতিরিক্ত ব্রেস(Brace) পরাতে হয়, এর ফলে বাইকের সামনের অংশ ভারি হয়ে যায়। কিন্তু সুবিধা হলো দামে সস্তা, দেখতে সুন্দর, মসৃণ এবং স্বয়ংসম্পুর্ন । Girder forks এর থেকে সব দিক দিয়েই ভালো। যারা স্টাইল পছন্দ করে তাদের জন্য আদর্শ।
BMW এর পথ ধরে সব নামি দামী ব্রান্ডই এখন এই টেলিস্কোপিক ফর্ক ব্যবহার করে। মজার ব্যাপার হলো বিএমডব্লিউ যে টেলিস্কোপিক ফর্কের পথ প্রদর্শক হলেও ১৯৫৫ সালের পরে তারা এর ব্যবহার বন্ধ করে দেয় কিন্তু অন্যরা তা করেনি, বরং তারা টেলিস্কোপিক ফর্কের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য নানা গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে। প্রগ্রেসিভ ফর্ক স্প্রিং ব্যবহার করে ব্রেকের সময় সাস্পেনশান ড্রাইভকে কমানো হয়েছে, অনেকে প্রেসারাইজড বাতাস ব্যবহার করে স্প্রিং রেটকে প্রগ্রেসিভ করার চেষ্টা করেছে।
১৯৬৮ সালে বিএমডব্লিউ আবারও টেলিস্কোপিক ফর্ক ব্যবহার শুরু করে এবং ১৯৭০ সাল নাগাদ তারা তাদের সব বাইকেই টেলিস্কোপিক ফর্ক ব্যবহার শুরু করে।
১৯৬৯ সালে হোন্ডা TRAC – Torque Reactive Anti-dive Control প্রযুক্তি টেলিস্কোপিক ফর্কে ব্যবহার করে। এর ফলে ব্রেকের সময় সাস্পেশানের ড্রাইভকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
১৯৮০ র দশকে কাওয়াসাকি AVDS – Automatic Variable Damping System যুক্ত করে টেলিস্কোপিক ফর্কে । এক্ষেত্রে ব্রেকের ব্রেকের হাইড্রোলিক প্রেসার ব্যবহার করে, ব্রেকিং এর সময় টেলিস্কোপিক ফর্কের ড্রাইভকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ইয়ামাহা এবং সুজুকিতেও একই প্রযুক্তি আছে।
৯০ এর দশকের মাঝামাঝি ইয়ামাহা BASS (Brake Actuated Suspension System) ব্যবহার করে, এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ড্রাইভ থেকে টেলিস্কোপিক ফর্ককে অনেকটাই মুক্ত করে তারা।
সময়ের সাথে সাথে বাইকের গতি যেমন বেড়েছে তেমনি ওজনও বেড়েছে। আগে যেখানে টেলিস্কোপিক ফর্কের ব্রেস হ্যান্ডেলের নিচে লাগানো থাকতো নতুন ডিজাইনে তা এখন চাকার উপরে লাগানোর ডিজাইন করা হয়। আধুনিক সুপার বাইকে এখন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
৮০ দশকে ব্রিটিশ কোম্পানি Saxon-Motodd টেলিস্কোপিক ফর্কে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। তারা টেলিস্কোপিক ফর্কের ব্রেস, হ্যান্ডেলের নিচে লাগানোর পরিবর্তে সামনের চাকার উপরে একটি বিয়ারিং দিয়ে যুক্ত করে দেয় অপর প্রান্ত বাইকের পিভট পয়েনেটের সাথে যুক্ত থাকে। সাথে হ্যান্ডেল ব্রেসে একটা স্প্রিং ডাম্পার(Damper) লাগিয়ে দেয়। এটি অত্যান্ত দক্ষ ও কার্যকর এন্টী ড্রাইভ সিস্টেম। বিএমডব্লিউ ১৯৯৪ সালে তাদের “Telelever” মডেলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মজার ব্যাপার হলো এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি অন্য কোন দামি ব্র্যান্ড কপি করেনি।
পরিশেষে বলা যায় গুরুতর কিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১০০ বছর ধরে টেলিস্কোপিক ফর্ক দাপটের সাথে রাজত্ত্ব করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত একে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন ও কার্যকর কোন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়াররা উপহার দিতে পারেন নাই। আর সত্য বলতে কি টেলিস্কোপিক সাস্পেনশান কাজও করে ভালো। তবে এ কথাও সত্য বর্তমানে টেলিস্কোপিক ফর্ক তার উৎকর্ষতার শীর্ষে আছে। ভালো যা কিছু সম্ভব তার সবই করা হয়ে গেছে। নতুন কিছু সাস্পেনশান প্রযুক্তি নিয়ে গবেষনা চলছে যা তাদের ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে রয়েছে। কে জানে হয়ত ভবিষতে এদেরই কোন একটা টেলিস্কোপিক সাসপেনশনের যায়গা দখল করে নিবে।