মোটরসাইকেল টায়ার কোড
আপনি কি কখনো ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেলের সোলের কারণে পিছলে গিয়ে পড়ে গিয়েছেন বা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছেন? তখন কি মনে হয়? আর একদিনও না, আজকেই স্যান্ডেল বদলাতে হবে। বেশীরভাগ মানুষেরই সেটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমরা কতো অল্প গতিতেই না ক্ষয়ে যাওয়া সেন্ডেলের সোলের কারণে পিছলে যাবার ভয়ে স্যান্ডেল বদলে ফেলি। ভাবুন একবার বাইকে কতো গতিতে পিছলে যাবার ভয় থাকবে যদি আমরা ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার ব্যবহার করি। আর পিছলে গেলে কি হতে পারে?
আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না কখন টায়ার বদলাতে হবে। আমাদের যদি এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকে তবে অনেক বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি। আসুন জেনে নেই কখন আপনার বাইকের টায়ার বদলের সময় হয়েছে।
অনেক সময় খালি চোখে টায়ার দেখে ভালো মনে হলেও মোটামুটি ১২০০০ মাইল বা ২০০০০ কিমি রান করার পরেই টায়ার ঝুকিপুর্ন হয়ে ওঠে এবং তা বদলে ফেলা উচিৎ।
মোটরসাইকেলে দৃশ্যমান এবং সবচেয়ে ব্যবহৃত অংশগুলোর একটি হলো টায়ার। বাইকার বাইকে চেপে থাকলে আর বাইক চেপে থাকে টায়ারের উপরে। আর তাই একটি বাইকে টায়ারের গুরুত্ব অপরিসীম।বাইক ভেদে টায়ার হয় বিভিন্ন রকমের। কোনটা চিকন, কোনটা মোটা, কোনটা সাইজে বড় আবার কেউ ছোট। রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গ্রীপের ডিজাইন। আমরা কখনও কখনও সমস্যায় পড়ি যে বাইকে কোন চাকায় কতটুকু পাম্প দিতে হবে, আমার বাইকে অমুক টায়ার লাগবে কিনা, বা আমার বাইকের টায়ার সাইজই বা কত। আমার টায়ারটি কম পুরোনা বা কত আগে প্রস্তত হয়েছে। টায়ারটি কবে পাল্টাতে হবে। টায়ার সংক্রান্ত এরকম প্রয়োজনীয় প্রায় সকল জিনিসই টায়ারের গায়ে দেয়া থাকে। কখনও সিম্বল বা বিশেষ চিহ্ন দিয়ে, আবার কখনও নাম্বার দিয়ে। এসকল চিহ্ন বা নাম্বারের সাথে পরিচিত থাকলে টায়ার নিয়ে আপনাকে কোনো অদক্ষ মেকানিক্সের উল্টাপাল্টা পরামর্শের উপরে নির্ভর করতে হবে না। আসুন পরিচিত হই এমনই কিছু চিহ্ন এবং নম্বররে সাথে।
টায়ারের সাইজ
প্রতিটি টায়ারের নির্দিষ্ট সাইজ রয়েছে। সাইজটি দুই ভাবে পরিমাপ হয়। প্রথমত এটি চওড়া কতটুকু, আর দ্বিতীয়ত এর ব্যাসার্ধ কতটুকু। যেমন কোন টায়ারে যদি লেখা থাকে ৩.২৫-১৮ এর অর্থ হলো টায়ারটি ৩.২৫ ইঞ্চি মোটা এবং এর ব্যাস ১৮ইঞ্চি। আবার কখনও লেখা থাকে ১১০/৯০-১৭, এর অর্থ টায়ারটি ১১০মিলিমিটার চওড়া, ৯০মিলিমিটার উচ্চতা ও ব্যাস ১৭ ইঞ্চি।
টায়ারে বাতাসের পরিমাপ
টায়ার ভেদে পাম্প বা বাতাসের পরিমান আলাদা হয়। টায়ারে কি পরিমান পাম্প দিতে হবে তা টায়ারের গায়েই লেখা থাকে। এর পরিমাপের একক PSI(Pound per Square Inch). টায়ার প্রেশার সঠিক না থাকা দ্রুত টায়ার ক্ষয়ে যাবার অন্যতম একটা কারণ।টায়ার প্রেশারের উপরেই নির্ভর করে ঠিক কতটুকু রাবার রাস্তার সংস্পর্সে আসবে। অতিরিক্ত টায়ার পেসার থাকলে টায়ার সম্পুর্ন বিট গ্রিপ দিয়ে রাস্তা আঁকড়ে থাকতে পারবে না । দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকবে অন্যদিকে টায়ার প্রেশার কম থাকলে টায়ার অতিরিক্ত গরম হবার কারণে দ্রুত ক্ষয়ে যাবে।
কি ভাবে বুঝবেন আপনার টায়ারের সঠিক প্রেশার কতো হওয়া উচিৎ? উত্তর খুব সহজ, সব কোম্পানিই তাদের টায়ারের সাইড ওয়ালে ম্যাক্সিমাম PSI উল্লেখ করে দেয়। কোম্পানি এক্ষেত্রে আপনি পেছনে সম্ভাব্য কতটুকু ওজন বহন করবেন সেই হিসাবেই এই ম্যাক্সিমাম PSI দিয়ে থাকে এবং কতটুকু ওজন আপনি বহন করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট টায়ারে তাও টায়ারের ওয়ালে উল্লেখ থাকে। তাই সর্বোচ্চ টায়ার প্রেসার মানে এই না যে এইটাই আদর্শ । আপনি যদি অধিকাংশ সময় একাই রাইড করেন তাহলে সর্বোচ্চ টায়ার প্রেসারের সামান্য নীচে রাখবেন PSI. অনেক টায়ারে সাইজের পরেই বাতাসের পরিমাপ উল্লেখ থাকে যেমন 42P বা 56P ইত্যাদি।
টায়ারের উৎপাদন তারিখ
আপনি যদি নিয়মিত বাইক চালান স্বাভাবিক নিয়মেই টায়ার ক্ষয়ে যাবে । কিন্তু বাইক যদি না চালিয়ে ফেলে রাখেন বা কম চালান ? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে টায়ার ভালো আছে কিন্তু UV রেডিয়েশান, ওজন এমন কি অক্সিজেন পর্যন্ত আপনার টায়ারের ক্ষতি সাধন করে থাকে যা খালি চোখে আপনি দেখতে পাবেন না। এক কথায় টায়ারের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া। টায়ারের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া বা tire’s age সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকা জরুরী । বেশীর ভাগ এক্সপার্টই একমত হন যে কম চালানোর কারণে টায়ার ভালো থাকলেও ৬ বছরের অধিক একটি টায়ার ব্যবহার করা উচিৎ না। এরপরে টায়ার বদলে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবং এক্ষেত্রে আপনি কবে টায়ার কিনেছেন তা গুরুত্তপূর্ন না বরং কবে টায়ার তৈরি হয়েছে তাকে গুরুত্ত দিন । প্রতিটি টায়ারের গায়ে উৎপাদন তারিখ লিখা থাকে। টায়ারের উৎপাদন তারিখ টায়ার ওয়ালে চার ডিজিটে উল্লেখ থাকে। প্রথম দুটি দিয়ে সপ্তাহ এবং পরের দুটি দিয়ে বছর বুঝানো হয় । যেমন ধরুন 0614 মানে ২০১৪ সালের ষষ্ঠ সপ্তাহে টায়ারটি তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি সূর্যের আলো এবং অতিরিক গরম হলেও টায়ারের ক্ষতি হতে পারে। টায়ারের গায়ে অনেক সময় সুক্ষ ফাটল দেখা যায় এগুলি হয় SUN rot এর কারণে । আবহাওয়া গত বা বয়স গত কারণে টায়ারের ক্ষয়কে ছোট করে দেখবেন না ।
টায়ার ঘুর্নন দিক
রীম বা হুইলে টায়ার লাগানোর নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। কেননা টায়ারের বিট/থ্রেড এর ডিজাইন করা হয় টায়ারের সামনে ঘুরবে সেইভাবে। টায়ারটি কোনদিকে ঘুরবে তার জন্য একটি দিক নির্দেশক তীরচিহ্ন রয়েছে টায়ারের গায়ে।
সর্বোচ্চ গতি
বাইক ভেদে টায়ারের ধরনও আলাদা। একটি টায়ার সর্বোচ্চ কত গতিতে চলতে পারবে তা তার গায়ে উল্লেখ থাকে। যেমন B মানে এই টায়ারের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৫০কিমি/ঘন্টা, J মানে ১০০কিমি/ঘন্টা অথবা Z থাকলে বুঝতে হবে ২৪০কিমি/ঘন্টা বা তারও অধিক।
সর্বোচ্চ লোড
প্রতিটি টায়ারের লোড নেবার একটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। টায়ারের গায়ে সেটি লেখা থাকে। অতিরিক্ত লোড বহন করলে টায়ার গরম হয়ে ক্ষয় হয়ে যায় এমনকি ফেটে যেতে পারে। টায়টাটুবকিআটায়ারের লোড ক্ষমতা বিশেষ নম্বর দিয়ে বলে দেয়া থাকে বা অনেক টাযারে সরাসরি উল্লেখ থাকে। যেমন ৩০ মানে তার ধারন ক্ষমতা ১০৬ কেজি, ৪০ মানে তার ধারন ক্ষমতা ১৪০ কেজি, বা ৯০ মানে তার ধারন ক্ষমতা ১৬০ কেজি।
TWI
আপনি যখন আপনার বাইককে পিক লেভেলে নিয়ে যাবেন ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার তা সহ্য না করার সম্ভাবনাই বেশী । আপনার চোখে টায়ার ভালো মনে হলেও অধিকাংশ টায়ার কোম্পানিই তাদের টায়ারে সেফটি মার্ক ( tire/tread wear indicator ) দিয়ে থাকে যা দেখে সহজেই বুঝা যায় টায়ার বদলানোর সময় হয়েছে।
Tire wear indicator (TWI) হোল টায়ারের দুই বিটের মাঝে সামান্য উঁচু হয়ে থাকা একটা ছোট রাবার। প্রায় সব ধররনের টায়ারেই এই TWI থাকে। আপনাকে শুধু খুঁজে নিতে হবে। সহজে খুঁজে পাবার জন্য টায়ারের সাইড ওয়ালে TWI লেখা থাকে বা এ্যারো মার্ক করে দেয়া হয় । নতুন টায়ারে খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হয় কিন্তু টায়ার কিছু পুরাতন হলে সহজেই দৃষ্টি গোচর হয়। টায়ার ক্ষয়ে নির্দেশক বিট বরাবর হয়ে গেলেই টায়ার পাল্টানোতে আর দেরী করা যাবে না।
আরো কিছু কোড
M+S: MUD এবং SNOW বুঝতেই পারছেন এর অর্থ হচ্ছে এই টায়ার কাদা বা বরফে চলার উপযুক্ত।
TL: Tube Less
TT: Tube Type
LL: Light Load
আমরা যেমন ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল এক মুহুর্ত পায়ে রাখতে চাইনা তেমনি ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার বা পুরাতন টায়ার নিয়েও এক মুহুর্তও বাইক চালানো উচিৎ না। এই অভেলার বা অলসতার উচ্চ মূল্য দিতে হতে । এর পাশাপাশি টায়ার সম্পর্কে সঠিক আর স্বাচ্ছ ধারণা আমাদের থাকা উচিৎ। কতটুকু পাম্প দিতে হবে, সর্বচ্চ লোড ক্যাপাসিটি কতো, টায়ারের ঘুর্নন দিক , উৎপাদন তারিখ ইত্যাদি বিষয় জানা থাকলে অনেক অনাকাংক্ষিত ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাবো।