বাংলাদেশে বাইক রাইডের জনপ্রিয় রুট
বর্তমানে বাংলাদেশি রাইডারদের মধ্যে বাইক নিয়ে ট্যুরের প্রবণতা দেখা দিয়েছে । এই ট্যুরের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উন্নত রাস্তাঘাট , এক্সপ্রেক্স ওয়ে, ভালো মানের বাইক ইত্যাদি। একজন বাইকার সবসময় চান আরামদায়ক ও নিরাপদ রাইড সেজন্য রাস্তার পাশাপাশি বাইকের ফিচারসও এক্ষেত্রে উন্নত করতে দেখা যায়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মধ্যে বেশকিছু রুট রয়েছে যেগুলো অন্যান্য রুটের থেকে বাইকাররা বেশি পছন্দ করে থাকেন। চলুন এক নজরে দেখে নিই বাইকাররা কোন কোন রুটে বাইক নিয়ে ট্যুর দিতে বেশি পছন্দ করে থাকেন এবং এই রুটগুলোকে আমরা জাতীয় রুট হিসেবেও বলতে পারি।
শাহজালাল থেকে শাহ মখদুম
হযরত শাহজালালের মাজার সিলেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। যারা সিলেট ভ্রমনে আসেন তারা অনন্ত একবারের জন্য হলেও এই শাহজালালের মাজার প্রদক্ষিন করেন। এই মাজারটি সিলেট সদরের অন্তর্গত এবং সিলেট শহরের ঠিক মধ্যস্থলে এবং '০' পয়েন্টের ১ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে। স্থানীয়ভাবে এলাকাটিকে দরগা এলাকা এবং প্রবেশপথটিকে দরগা গেইট বলা হয়।
অন্যদিকে শাহ মখদুম (রঃ) চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ তথা রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। তার অনুপম ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। মূলত শাহ মখদুমের মাধ্যমেই বরেন্দ্র এবং গৌড় অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে এসব অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। শাহ মখদুমের প্রকৃত নাম আব্দুল কুদ্দুস। রাজশাহীতে এটা খুবই গুরত্বপুর্ন একটি স্থান এবং যারা রাজশাহী ভ্রমন করতে আসেন তারা এই মাজার শরীফ প্রদক্ষিন করে থাকেন। এই মাজারটি শহরের প্রান কেন্দ্র জিরোপয়েন্ট কিংবা মনিচত্ত্বর থেকে খুব কাছে দরগা পাড়ায় অবস্থিত এবং এর পাশদিয়েই বয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা।
শাহজালাল মাজার থেকে শাহ মখদুম মাজারের দুরত্ব প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার। যারা বাইক নিয়ে ভ্রমন করে থাকেন তারা এই রুটটি একবারের জন্য হলেও একটা ট্যুর আয়োজন করতে পারেন এবং মজার বিষয় হল এই দুইটি মাজার বাংলাদেশের এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্ত।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া (TT)
টেকনাফ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা এবং এটি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা।টেকনাফ উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান সড়ক কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক। সব ধরনের যানবাহনে যোগাযোগ করা যায়।টেকনাফ উপজেলার পূর্বে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নাফ নদী। বাইকাররা সাধারণত টেকনাফের জিরোপয়েন্ট থেকে তাদের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া (TT) ট্যুরের যাত্রা শুরু করে এবং তেতুলিয়া গিয়ে শেষ করে ।
‘‘তেতুলিয়া” একটি নাম যা দেশের সকলের নিকট এক নামে পরিচিত। প্রাচীন কালে এ এলাকায় প্রচুর তেতুল বৃক্ষ ছিল। তেতুল গাছের ছায়ায় বসে পথিকেরা বিশ্রাম নিত। এক সময়ে এখানে একজন বিশিষ্ট ইংরেজ বনিক টিটু বাস করত এবং তার বাসগৃহ ছিল একটি উঁচু টিলার উপর। সেখানে একটি তেতুল গাছ ছিল। কালক্রমে সেই ইংরেজ বনিকের বাবার নাম ‘‘টেটু”এবং তেঁতুল তলা হতে ‘‘লিয়া” এ দু’শব্দের সমন্বয়ে এ জনপদের নামকরন হয় ‘‘তেতুলিয়া।
বাইকাররা সাধারনত তাদের সুবিধার স্থান থেকে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া যাত্রা শুরু করে থাকে। যারা তেতুলিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে তারা টেকনাফ গিয়ে শেষ করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মোট দূরত্ব প্রায় ৯১৪- ৯২০ কিলোমিটার। এক সীমানা থেকে আরেক সীমানা রুট হওয়ার কারনে বেশিরভাগ বাইকারদের কাছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া (TT) ট্যুর অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
তামাবিল – টেকনাফ –তেতুলিয়া ৯ (TTT)
তামাবিল হচ্ছে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সীমান্তবর্তী একটি এলাকা, যা জাফলং যাবার ৪ কিলোমিটার আগে অবস্থিত। এখান থেকে ভারতের পাহাড়, ঝর্ণা ছাড়াও অনেক দর্শনীয় স্থান অবলোকন করা যায়। তামাবিলের সবচেয়ে কাছের নদীটির নাম তাইরঙ্গল। তামাবিল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখান থেকে সরাসরি ভারতের পাহাড়, পর্বত, ঝর্ণা, জলপ্রপাত দেখা যায়। সীমান্তের ওপারে অনেক গুলো জলপ্রপাত রয়েছে এই জলপ্রপাত গুলো বিকাল বেলা ও গোধূলির সময় দেখতে চমৎকার লাগে।
বাইকারদের কাছে এই রুটটিও বেশ জনপ্রিয়। অনেক বাইকার আছেন যারা টেকনাফ থেকে যাত্রা শুরু করে অথবা তেতুলিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে তামাবিল হয়ে টেকনাফ পৌঁছায় অর্থাৎ তামাবিল হচ্ছে সেন্ট্রাল যাকে কেন্দ্র করে টেকনাফ তেতুলিয়া বা তেতুলিয়া টেকনাফ ট্যুর করা হয়ে থাকে।
৬৪ জেলা
বাংলাদেশী বাইকারদের জনপ্রিয় ও স্বপ্নের একটি ট্যুর হচ্ছে এই ৬৪ জেলা ট্যুর। অনেকেই ৬৪ জেলা একটি টার্গেট নিয়ে কভার করে থাকেন, কেউ কেউ ৪ দিনে কভার করেছেন এমন রেকর্ড ও রয়েছে। এই ৬৪ জেলা ট্যুর সম্পন্ন করার মাধ্যমে একজন বাইকার তার বাইকিং জীবনে বড় কিছু অর্জন করে থাকেন এবং অনেকেই এটা বড় একটা অর্জন হিসেবে ধরে থাকেন। এই ট্যুরটি কেউ বাংলাদেশের উত্তারঞ্চল , দক্ষিনাঞ্চল কিংবা যার যার স্থান থেকে যে অঞ্চল কাছে সেখান থেকেই শুরু করে ৬৪ জেলা ভ্রমন করে এই ট্যুর শেষ করে থাকেন।
৮ বিভাগ
বাংলাদেশি বাইকারদের মাঝে আরেকটি জনপ্রিয় ও রোমাঞ্চকর ট্যুর হচ্ছে ৮টি বিভাগ একসাথে কভার করা। ৬৪ জেলা এক সাথে শেষ করার পর অনেক বাইকার আছেন যারা ৮টি বিভাগ একত্রে ট্যুর দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট একটি বিভাগীয় জেলা থেকে এই ট্যুর শুরু হয় এবং নির্দিষ্ট একটি বিভাগীয় জেলা এটা শেষ হয় । এটা শুনতে সহজ যে ৮ বিভাগ ট্যুর কিন্তু করে দেখানো অনেক কঠিন।
কেওক্রাডং সামিট
কেওক্রাডং বা কেওকাড়াডং বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা বান্দরবানে অবস্থিত। এক সময় এটিকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ধরা হত কিন্তু বর্তমান গবেষণা অনুযায়ী তাজিংডং কে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশী বাইকারদের মধ্যে জনপ্রিয় ও অত্যান্ত চ্যালেঞ্জিং একটি বাইক ট্যুর হচ্ছে এই কেওক্রাডং সামিট । অনেক বাইকার আছেন যারা এই স্থানে পৌছাতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। বর্তমানে এই স্থানে অনেক বাংলাদেশি বাইকারগন বাইক নিয়ে ট্যুর দিয়েছেন ।
বর্ডার লাইন বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ৮ টি বিভাগে মোট জেলার সংখ্যা হল ৬৪। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে ৩২ টি। এই সীমান্তবর্তী জেলাগুলো ভারত ও মিয়ানমার এর সাথে।ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ৩০ টি জেলার আর মিয়ানমারের সাথে রয়েছে ৩টি জেলার। এদের মধ্যে ১টি জেলার (রাঙ্গামাটি) আবার দুই দেশের সাথেই সীমান্ত রয়েছে। বরিশাল ও ঢাকা বিভাগ ব্যতীত সকল বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী যে জেলাগুলো রয়েছে চলুন এক নজরে সেগুলো দেখে নিই।
মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ৩টি সীমান্তবর্তী জেলা হল কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান।
চট্টগ্রাম বিভাগের - চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি,
খুলনা বিভাগের - সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া,
রাজশাহী বিভাগের - রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও জয়পুরহাট,
রংপুর বিভাগের - পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম,
ময়মনসিংহ বিভাগের - জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা,
সিলেট বিভাগের - সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ।
এছাড়াও বাংলাদেশী বাইকাদের মধ্যে বর্তমানে অনেক স্থানে ট্যুরের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং দিন দিন নতুন নতুন স্থান আবিস্কার হচ্ছে। আশা করা যায় বাইকাররা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাস্তায় তাদের বাইক নিয়ে নতুন নতুন কিছু অর্জন করবে এবং বাংলাদেশের বাইকিংকে সমৃদ্ধ করবে।