নতুন মোটরসাইকেল কেনার পূর্বে এবং পরে করনীয় কাজ সমূহ
যারা নতুন বাইক কিনেছেন বা সামনে কিনবেন এই লেখাটি শুধু তাদের জন্য । আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং এক্সপার্টদের মতামত বিশ্লেষণ করে কিছু মেইন্টেনেন্স টিপস দিচ্ছি এবং কিছু টপিক তুলে ধরছি যেগুলো আপনাদের কমন কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবে আশা করি ।।
বাইক কেনার পূর্বে করনীয়
১) অধিকাংশ মতামতের ভিত্তিতে বা ১০ টা মানুষকে না জিজ্ঞেস করে নিজের যে বাইক টা ভালো লাগে বা পছন্দ হয় সেটা কেনার চেষ্টা করুন । আপনি যখন ১০ জন মানুষকে জিজ্ঞেস করবেন তারা উত্তর দিবে ১০ রকম এইটাই স্বাভাবিক । আপনার মন যেটা বলে সেটা কিনুন ।
২) এখন যে কাজ এর কথা বলবো সেটা আমি নিজেও করিনি কিন্তু না করার কারনে এখন কিছুটা হলেও পস্তাতে হয় । আপনি বাইক কেনার আগেই আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স যদি না থেকে থাকে সেটার জন্য আবেদন করুন । এতে বাইক কিনতে কিনতে আপনার লাইসেন্স চলে আসলে আর ভেজাল হবে না ।
৩) খোঁজ নিন বাইকের স্পেয়ার পার্টস এবং ভালো সার্ভিস সেন্টার আছে কিনা।
বাইক কেনার সময় করনীয়
১) একটা ভালো বিশ্বাসযোগ্য/রেপুটেড শোরুম থেকে বাইক কিনুন । বাইক কেনার সময় বাইকের সব নাট বলটু ঠিক আছে কিনা, সব রকমের পার্টস ঠিক আছে কিনা, কোন পার্টস ভাঙ্গা বা পুরাতন কিনা, টায়ার লিক আছে কিনা এগুলো চেক করে নিন । টেস্ট ড্রাইভ করে বুঝে নিন সব ঠিক ঠাক চলছে কিনা । না হলে অভিযোগ করুন শোরুম এর কাছে ।
২) বাইকের নাম্বার করার জন্য যে চালানের কাগজ দরকার পরে সেটা একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে বুঝে নিন । সাধারণত একেক শোরুম এ একেক অংকের টাকা চায় । তবে এইটা ১০০০-২০০০ এর মধ্যেই হয়ে যাবে । যদি শোরুম থেকে নাম্বার করান তাহলে তারা আপনার নাম্বার করার রশিদ এর সাথেই এই টাকা যোগ করে দিবে । নিজে নিজে নাম্বার করতে চাইলে এই কাগজ আপনাকে বিআরটিএ তে জমা দিতে হবে (অবশ্যই একটা ফটোকপি রাখবেন) ।
৩) শোরুম থেকে সার্ভিস ম্যানুয়াল, বাইক এর ম্যানুয়াল এবং সার্ভিস টোকেন বুঝে নিন । সার্ভিস টোকেন ছাড়া আপনাকে ফ্রি সার্ভিস তারা দিবে না । আপনি আপনার বাইক এর জন্য ৩-৪ টা ফ্রি সার্ভিসিং পাবেন । বাইক এর ম্যানুয়াল অনেকে তুচ্ছ মনে করে এই ব্যাপারে পরে আসছি বিস্তারিত ।
বাইক কেনার পরে করনীয়
১) নতুন বাইক কিনে ঘরে ফিরেছেন । উত্তেজনা তুঙ্গে থাকবে নতুন বাইক চালানোর এবং বন্ধুদের কে দেখানোর । কিন্তু একটু অসাবধানতা আপনার জন্য আর আপনার বাইক এর জন্য কাল হয়ে দাড়াতে পারে । যদি ঢাকা বা অন্য কোন মেট্রো শহরে থাকেন নাম্বার না পাওয়া পর্যন্ত বাইক কোনভাবেই মেইন রাস্তায় চালাবেন না । নাম্বার বিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো আইনত নিষেধ । পুলিশি ভেজাল এ পড়লে সোজা ডাম্পিং এ দিয়ে দিবে এবং রেকার চার্জ দিয়ে বাইক ছাড়াতে হবে । কাগজ পত্র না থাকার মামলা তো আছেই । কপাল খারাপ হলে নিজের শখের বাইক আর ফিরে নাও পেতে পারেন । কাজেই অপেক্ষা করুন নাম্বার পাওয়ার আগ পর্যন্ত । সাধারণত টাকা জমা দেবার সর্বচ্য ১ মাসের মধ্যেই নাম্বার চলে আসবে ।
২) ইনস্যুরেন্স করিয়ে ফেলুন । ইঞ্জিন নাম্বার এবং চেসিস নাম্বার দিয়েই করাতে পারবেন । ইনস্যুরেন্স না থাকলে মামলা গুনতে হবে ২০০০ টাকার । ২৫০-৩০০ টাকা লাগবে ইনস্যুরেন্স করাতে ।
৩) বাইক এর ম্যানুয়াল বই পুরোটা পড়ে ফেলুন । অনেক কাজে দিবে আর অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন । বাইক এর টায়ার প্রেশার , ব্রেক ইন পিরিয়ড, পিরিয়ডিক মেইন্টেনেন্স, ইঞ্জিন অয়েল গ্রেড সবই লেখা আছে ম্যানুয়াল বইতে । এইটা পড়লে কষ্ট করে আপনাকে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে পোস্ট দিতে হবে না অনেক জায়গায় । এই ম্যানুয়াল বই কে বলি একটা বাইক এর বাইবেল ।
৪) ব্রেক ইন পিরিয়ড মেনে চলার চেষ্টা করুন । আপনার ম্যানুয়াল বই অনুযায়ী ব্রেক ইন করুন । ব্রেক ইন এর প্রথম অর্ধেক সময় ৪৫০০আরপিএম এর মধ্যে চালাবার চেষ্টা করুন । তারপরের অর্ধেক সর্বচ্য ৬৫০০ আরপিএম । ব্রেক ইন এর সময় হ্যাঁচকা টান দিবেন না । আস্তে আস্তে গতি উঠাবেন ।
৫) ইঞ্জিন অয়েল বাইক কেনার পর একটু তাড়াতাড়ি বদলাবেন । ৩০০-৪০০ কিলোর মধ্যে । বাইক যেহেতু নতুন মিনারেল বা সিনথেটিক যেকোনো টাইপ এর অয়েল ব্যাবহার করতে পারেন । ব্রেক ইন পুরাপুরি শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই মিনারেল ব্যাবহার করতে বলে কারন এর দাম কম এবং ব্রেক ইন এর সময় ইঞ্জিন অয়েল অনেক দ্রুত বদলাতে হয় বলেই মিনারেল দিতে বলে সবাই কারন সিনথেটিক অয়েল এর দাম অনেক বেশি । তবে ব্রেক ইন এ আপনি যে সিনথেটিক ব্যাবহার করতে পারবেন না এইরকম কোন কিছু নেই । আপনি চাইলে শুরু থেকেই ব্যাবহার করতে পারবেন সিনথেটিক । কিন্তু সিনথেটিক অয়েল এর দাম বেশি হওয়ায় আর ব্রেক ইন এর সময় অনেক তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন অয়েল বদলাতে হয় বলেই অনেকে সিনথেটিক দিতে বারন করেন । বাইক কেনার পর মিনারেলই দিতে হবে সিনথেটিক দেওয়া যাবেনা এটার কোন নিয়ম আজ পর্যন্ত কোথাও আমি দেখি নি । অথেনটিক কোন তথ্য যদি কারো এ বিষয়ে জানা থাকে বললে আমি শুধরে নেব ।
৬) ব্রেক ইন শেষ হয়ে গেলে আস্তে আস্তে বাইক বেশি আরপিএম এ রাইড করুন । বাইক তখন হালকা হয়ে যাবে চালিয়েও মজা পাবেন । আপনার সার্ভিস ম্যানুয়াল অনুযায়ী সার্ভিসিং করান । শোরুম থেকেও করাতে পারেন বাইরে থেকেও । শোরুম থেকে সার্ভিসিং করান আর বাইরে থেকে । অবশ্যই অবশ্যই খেয়াল করবেন বাইক সার্ভিসিং এর আগে এবং পরে ভালো পারফর্ম করছে কিনা । আপনার কোন সমস্যা মনে হলে বলবেন সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার কে ।
৭) কমপক্ষে ৮ হাজার কিলো না চালানো পর্যন্ত ইঞ্জিন হেড খুলবেন না একদম দরকার না হলে । ভাল্ভ লুজ হলে\ট্যাপেট লুজ হলে বাইক এর শব্দ বেড়ে যাবে কিন্তু এতে কোন ক্ষতি নেই । নতুন বাইক এর ইঞ্জিন মানে নতুন জন্ম নেওয়া বাচ্চা । নতুন বাচ্চাকে যদি বয়স না হওয়ার আগে পেট কাটেন তাহলে ব্যাপার টা যেমন হয় এখানে ব্যাপার টা তেমনই । বাইক এর সাউন্ড খারাপ মনে হলেও ৮ হাজার কিলো কষ্ট করে চালাতে থাকেন । মনে রাখবেন নতুন বাইক এর সাউন্ড একরকম আর বাইক পুরান হলে সাউন্ড আরেকরকম । আশা করা যায় ৫-৬ হাজার কিলো হলেই সাউন্ড বদলে যাবে এবং ঠিক হয়ে যাবে । কাজেই ঘাবড়ানোর কিছু নেই । চালাতে থাকেন ।
৮) ব্রেক ইন শেষ হলে ইঞ্জিন অয়েল সময়মত বদলান । মিনারেল ব্যাবহার করলে ৫০০-৬০০ কিলো পর পর এবং সিনথেটিক ব্যাবহার করলে কমপক্ষে ২০০০কিলোর পর পর বদলান । মিনারেল থেকে যদি সিনথেটিক এ শিফট করেন তাহলে সিনথেটিক দেবার পর প্রথম ৫০০-৬০০ কিলো ইঞ্জিন অনেক গরম হবে এই মিনারেল থেকে সিনথেটিক এ অ্যাডজাস্ট হবার জন্য । প্রথম সিনথেটিক অয়েল ১৪০০-১৫০০কিলো হলেই ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা ভরবেন । আর অবশ্যই ম্যানুয়াল বই অনুযায়ী গ্রেড ঠিক রাখবেন ।
৯) ক্লাচ ক্যাবল, ব্রেক লিভার, গিয়ার লিভার এর খাজে খাজে গ্রিজ দেবেন । এগুলো লুব না করলে তাড়াতাড়ি ক্ষয় হবে এবং জাম হয়ে যাবে ।
১০) চেইন লুব করবেন নিয়মিত । পোড়া মবিল, গিয়ার অয়েল, চেইন লুব, সেলাই মেশিন এর তেল যেকোনো কিছু দিয়ে লুব করতে পারেন । অনেকে পোড়া মবিল দিতে নিষেধ করেন এর কারন এইটা অনেক ময়লা । কিন্তু এইটা দিলে কোন ক্ষতি নেই । আমি সহ আরও অনেকে দিচ্ছে কিছু হয় নাই ।
১১) মাসে একবার হলেও চেইন পরিষ্কার করবেন । কেরোসিন অনেক নামকরা একটা চেইন ক্লিনার । পুরো চেইন প্রথমে একটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে তারপর কেরোসিন দিবেন । দিয়ে ব্রাশ দিয়ে পুরো চেইন ঘশবেন । চকচকে হয়ে গেলে পুরো চেইন আরেকটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে ফেলবেন এবং তারপর লুব দিবেন ।
১২) খুব বেশি বেশি বাইক ওয়াশ করবেন না । মাসে একবার করুন ।
১৩) ম্যানুয়াল বই অনুযায়ী টায়ার প্রেশার ঠিক রাখুন এবং সপ্তাহে একবার বা ২ সপ্তাহে একবার চেক দিন।
১৪) সবচেয়ে দরকারি কথা । যদি বাইক এর ভালো চান এবং নিজের বাইক নিয়ে খুশি থাকতে চান তাহলে এই পন্থা অবলম্বন করুন । শুনতে অনেক তিক্ত আবার এই কারনে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয় । বুঝতেই পারছেন কি বলতে চাচ্ছি । হ্যা ঠিকই বুঝেছেন । নতুন বাইক এক্সপার্ট/ভরসা করা যায় এমন কেউ/ভালো রাইডার যার বুঝ আছে বাইক সম্পর্কে তাদের ছাড়া কাওকে দিবেন না ভুলেও । বন্ধুদের ও দিবেন না । কারন তারা আপনার জিনিস এর মর্ম বুঝবে না । তারা ইচ্ছা মত পিকাপ টানবে বাইক এর বারটা বাজাবে । সেটা আপনি নিশ্চই চান না? বন্ধু যদি বলে “দোস্ত একটু দে দেখি বাইক টা কেমন” , ভুলেও দিবেন না যদি সে এক্সপার্ট রাইডার বা বুঝদার কেউ না হয় । এতে হয়ত সে ভাব্বে আপনি ভাব নিচ্ছেন বা সবাইকে বলে বেড়াবে যে আপনি বাইক কিনেছেন এখন কাওকে চেনেন না । কিন্তু আপনি জানেন আপনি কেন করেছেন এইরকম । আশা করি বুঝতে পারছেন কি বলছি । এতে আপনার বন্ধু বা চেনা কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে কিন্তু আপনার এত শখ করে কেনা বাইক টা ভালো থাকবে ।।
আজ এ পর্যন্তই । কম কথায় প্রায় সব কিছুই বলে দিলাম । কোন ভুল ক্রুটি থাকলে ক্ষমার দৃষ্টি তে দেখবেন । আমি এখনও শিখছি ।।
ধন্যবাদ ।
লেখক: রাকিব মাহমুদ অভি, মডারেটর , এফআই ক্লাব বাংলাদেশ – এফিসিবি ।