সিনথেটিক নাকি মিনারেল ইনজিনঅয়েল, কোনটি ভালো?
বাংলাদেশের বাজারে নানারকম ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায়। কেউ অথরাইজড ডিস্ট্রিবিউটর আবার কোন কোম্পানি নিজ উদ্যোগে আমদানি করে থাকে। বিভিন্ন গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায় কিন্তু মান, গুন ও কার্যক্ষমতা বিবেচনায় তা তিন ক্যাটাগরির ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায়।
ইনজিনওয়েলের ধরন
সাধারনত তিনধরনের ইনজিনওয়েল দেখা যায়-
১. মিনারেল ইঞ্জিন অয়েল
২. সিনথেটিক ইঞ্জিন অয়েল
৩. সেমি-সিন্থেটিক ইঞ্জিন অয়েল
সিনথেটিক ইনজিন অয়েল
সিনথেটিক ইনজিন অয়েল যা সর্বোচ্চমানের পরিশোধিত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কেমিক্যাল সংযোজিত যে কোন ইঞ্জিনের সেরা পারফর্মেন্স ও নিরাপত্তার জন্য তৈরীকৃত। যা ইনজিনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করে, ইনজিনে সর্বোচ্চ সময় কার্যকর থেকে সেরা পারফর্মেন্স দেয় এবং ইনজিনের স্থায়ীত্বকাল বৃদ্ধি করে। সিনথেটিক অয়েলকে Group III, IV, V ইত্যাদিতে বিভক্ত করা হয়। যেহেতু এতে অন্যান্য কেমিক্যালস ব্যবহার করা হয়, তাই এর দাম একটু বেশী। এই ইঞ্জিন অয়েল লম্বা সময় ধরে ব্যবহার করলেও গুনাগুন অক্ষুন্ন থাকে। এই ইঞ্জিন অয়েল স্বাভাবিক ভাবে মোটরসাইকেলে ২০০০-৩০০০কিমি পরপর পরিবর্তন করা উত্তম।
মিনারেল ইনজিনঅয়েল
প্রকৃতি থেকে আরোহিত অপরিশোধিত তেল থেকে শোধনের মাধ্যমে মিনারেল ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায়। মিনারেল ইনজিন অয়েল দামে কম এ কারনে এতে অন্যান্য কেমিক্যাল যোগ করা হয়না। বিধায় ইহা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়না কিন্তু ইঞ্জিনের চাহিদা পুরনে সক্ষম। এই ইঞ্জিন অয়েল স্বাভাবিক ভাবে মোটরসাইকেলে ১০০০কিমি পরপর পরিবর্তন করা উত্তম।
সেমি-সিনথেটিক ইনজিন অয়েল
সেমি-সিনথেটিক কে সিনথেটিক ব্লেন্ড বা মিশ্রন ও বলা হয়। এখানে মিনারেল এবং সিনথেটিকের মিশ্রনে তৈরী হয়, তবে মিশ্রনে সিনথেটিক এর পরিমান কোনমতেই ৩০% এর বেশি নয়। কমদামে সিনথেটিক অয়েলের সুবধা নেবার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৬ সালে Motul সর্বপ্রথম এটি প্রচলন করে। এটি অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মিটানোর মত।
মিনারেল অয়েলের ভালো মন্দঃ
• দামে কম
• ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে
• উচ্চতাপে বা বেশি ঠান্ডায় কম কার্যকর
• সেরা পারফর্মেন্স এর জন্য উপযুক্ত নয়
• নিয়মিত চেঞ্জ না করলে ইঞ্জিনের পার্টস ক্ষয় বেড়ে যায়
• ইঞ্জিনে নানা রকম শব্দ হয়
• দ্রুত পাতলা হয়ে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়
• উপকারি ক্যামিকেল দেয়া থাকেনা আলাদাভাবে
• সর্বোচ্চ প্রযুক্তিতে পরিশোধিত নয়
মিনারেল অয়েলের খারাপ দিক
প্রাকৃতিকভাবে উত্তোলিত মিনারেল ইনজিনঅয়েল পরিশোধনের সময় সকল অপ্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দেয়া সম্ভব হয় না। এরফলে অতি তাপে বা অতি ঠান্ডায় সে তার কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। কখনও রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তার মুল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে পারে। যা ইনজিনের ক্ষতির কারন হতে পারে। প্রচলিত মিনারেল অয়েলে কিছু অপরিশোধিত উপাদান থেকে যায় যেমন sulfur, hydrocarbons, এবং অন্যান্য যৌগ। এগুলো ইনজিনের ভেতরে অনাকাংখিত রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটাতে পারে। এছাড়াও তেলের অনু গুলো ছোটবড় বিধায় সঠিকভাবে কার্যকর হয় না।
সিনথেটিক অয়েলের ভালো মন্দ
• দাম বেশী
• ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েনা
• উচ্চতাপে বা বেশি ঠান্ডায় সমান কার্যকর
• সেরা পারফর্মেন্স এর জন্য উপযুক্ত
• একনাগারে ২০০০-৩০০০কিমি চালানো যায়
• ইঞ্জিনে ময়লা জমতে দেয়না
• দ্রুত পাতলা হয়ে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়না
• উপকারি ক্যামিকেল দেয়া থাকে
• সর্বোচ্চ প্রযুক্তিতে পরিশোধিত
সিনথেটিক অয়েলের ভালো দিক
সিনথেটিক অয়লে ইনজিন চালু করা থেকেই তার কাজ শুরু করতে পারে যেখানে মিনারেল অয়েল কিছুটা সময় নেয় পুরো ইনজিনে ছড়িয়ে সমান ভাবে কার্যকর হতে, সেখানে সিনথেটিক অয়েল দ্রুত কাজ শুরু করতে পারে।
সিনথেটিক অয়েল গাড়ীর জ্বালানী খরচ কমায়। ইনজিন চালু হয়ে কাজর্করী হতে মিনারেল অয়েল কিছুটা সময় নেয়। এসময় গাড়ী তুলনামূলক কম গতি পায় এবং অয়েলের ঘনত্ব বেশি থাকাতে ইনজিনের ভেতরে পার্টস এবং ইনজিনঅয়েলের ঘর্ষন বেশি মাত্রায় থাকে। অপরদিকে সিনথেটিক অয়েল প্রতি মুহুর্তেই একইভাবে সমান কার্যকর থাকে। ফলে জ্বালানী খরচ কম লাগে।
সিনথেটিক অয়েলের আরো কিছু ভালো দিক
• অসাধারন কার্যকরী
• অল্প তাপমাত্রাতেও লুব্রিকেন্ট থাকে দারুন কার্যকর
• বেশি তাপমাত্রাতেও ইনজিনকে ঠান্ডা রাখে
• ইনজিনের ময়লা চমতকারভাবে পরিস্কার করে
• জমে থাকা ক্ষতিকারক পদার্থ থেকে রক্ষা করে
• ইনজিনের কার্যক্ষমতা বাড়ায়
• দ্রুত গতিতেও ইনজিনওয়েল কম খরচ হয়
• কম থেকে বেশি সকল তাপমাত্রায় সমান কার্যকর
• ইনজিনের ভেতরে ঘর্ষন কমিয়ে ইনজিনের স্থায়ীত্ব বাড়ায়
• সর্বোচ্চ রাসায়নিক বিক্রিয়াতেও সমান কার্যকর
• অতি তাপে বাষ্পিভূত হয়ে কমে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক কম থাকে।
• অনেক বেশি সময় ধরে কার্যকর থাকে।
• তেলের অনুগুলো প্রত্যেকে একই সমান বলে সঠিকভাবে কার্যকর হয়।
সিনথেটিক অয়েলের খারাপ দিক
• দাম বেশি
• সঠিক গুনগত মানের জিনিস বাজারে পাওয়ার নিশ্চয়তা কম
• অনেকেরই কার্যকারীতা সম্পর্কে সঠিক ধারনা নেই
• অল্প সিসির বাইক ব্যবহারকারীরা সিনথেটিক অয়েলে কম আগ্রহী এবং আমাদের দেশে অল্প সিসি বাইক ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি
নতুন পরিবর্তনে ইনজিন ফ্লাশ করুন
সিনথেটিক থেকে মিনারেলে বা মিনারেল থেকে সিনথেটিক ইনজিনওয়েল ব্যবহার করতে চাইলে ইনজিন ফ্লাশ করুন। এটি অনেকটা নুডুলসের বাটিতে সেমাই খাওয়ার মতো। একই বাটিতে নুডুলস খেয়ে পরে সেমাই খেতে গেলে একটু ঝাল ঝাল লাগতে পারে কিন্তু বাটিটি ধুয়ে নিলে পরে সেমাই এর পুর্ণ স্বাদ পাওয়া যায় তেমনি মিনারেল থেকে সিনথেটিক বা সিনথেটিক থেকে মিনারেল যেটিই ব্যবহার করেন না কেনো। সঠিক পারফরমেন্স পেতে ইনজিনটি ফ্লাশ করে নিন। এরপর আপনার পছন্দের ইনজিনওয়েল ব্যবহার করুন। ইনজিন ফ্লাশে কেরোসিন/পেট্রোল/ডিজেল ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।
কিভাবে ইনজিন ফ্লাস করবেন
• ইঞ্জিন চালু করে হালকা গরম করে নিন
• ফিলিং ক্যাপ খুলে ড্রেন নাট খুলুন
• সম্পূর্ণ অয়েল ড্রেন দিন
• ড্রেন নাট লাগান
• পরিমানমতো নতুন অয়েল দিন
• ফিলিং ক্যাপ লাগান
• মোটরসাইকেল স্টার্ট দিন
• কিছুক্ষন চালিয়ে পূর্বের ন্যায় ইঞ্জিন অয়েল ড্রেন দিতে পারেন অথবা ২০০/৩০০কিমি চালিয়ে ড্রেন দিয়ে নতুন অয়েল ভরুন।
• ব্যাস হয়ে গেলো ইঞ্জিন ফ্লাশিং করা।
• আসলে ইঞ্জিন ফ্লাশিং হচ্ছে ইঞ্জিনের ভিতরটা পরিস্কার করা, কারন এর ভিতরে ময়লা ও লোহার দানা, গাদ ইত্যাদি জমে ও পুরাতন অয়েল টাকে ফেলে নতুন করার উপায়।
ব্রেক ইন পিরিয়ডে কেন মিনারেল অয়ে্ল ব্যবহারের জন্য বলা হয়?
অনেকেই বলে থাকেন নতুন বাইকে প্রথম কিছুদিন মিনারেলঅয়েল ব্যবহার করে এরপরে সিনথেটিক অয়েল ব্যবহার করা ভালো। কিন্তু এর কারন কি? কারন ব্রেক ইন পিরিয়ডে কোম্পানিগুলোর নিয়মানুযায়ী যেহেতু ঘন ঘন ইঞ্জিন অয়েল পাল্টাতে হয় আর সিনথেটিক অয়েল দামি ফলে তা লাভজনক হয়না। এজন্য সবাই বলে থাকে ব্রেক ইন পিরিওডে মিনারেল ব্যবহার করুন কারন ইহা লাভজনক।
শেষ কথা
প্রাকৃতিক ভাবে খনি থেকে প্রাপ্ত মিনারেল ইঞ্জিন অয়েল যেমন সর্বজন পরিচিত এবং দামে কম তেমনি সিনথেটিক ইনজিন অয়েল দামে একটু বেশি কারন এতে বিভিন্ন উপকারী ক্যামিকেল মিশ্রিত করা থাকে ও সরবচ্চ প্রযুক্তিতে প্রস্থত যা দীর্ঘস্থায়ী এবং ইনজিনের জন্য ভালো। যদিও তুলনামুলক বিচার সিনথেটিক ইনজিন অয়েল ভালো তবুও ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল কোম্পানী কতৃক অনুমোদিত ইনজিন অয়েল ব্যবহার ইনজিনের জন্য সবসময়েই ভালো।
যদি সিনথেটিক ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করতে চান অবশ্যই মোটরসাইকেলের জন্য প্রস্তুত সিনথেটিক অয়েল ব্যবহার করুন। সেটি অবশ্যই সঠিক গ্রেডের হতে হবে যা মোটরসাইকেল প্রস্ততকারক দ্বারা নির্দেশিত।