মোটরসাইকেলের সাসপেনশনের প্রকারভেদ
মোটরসাইকেলে সাসপেনশনের ব্যবহার শুরু হয় বিশ শতকের শুরুর দিকে। শুরুতে সামনের চাকায় সাসপেনশনের ব্যবহার দেখা যায়। বহুল গবেষনালব্ধ ফলাফলে সাসপেনশনের জগতে টেলিস্কোপিক ফর্কটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যবহৃত পর্যায়ে রয়েছে। বলতে গেলে অন্যান্য সাসপেনশনগুলোও টেলিস্কোপিক ফর্ক এর রূপান্তরিত রূপ বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুলত মোটরসাইকেলের পেছনে সাসপেনশনের ব্যবহার শুরু হয়। শুরুতে শুধুমাত্র চালকে সীটের নীচে স্প্রীং লাগিয়ে কাজ সেরে নেয়া হতো। এর কারণও ছিলো, বাইকের ফ্রেমই এমন ছিল যে সাস্পেনশান লাগানোর উপাই ছিল না। অনেকটা সাইকেলের ফ্রেমের মতো পরস্পর টিউব জোড়া লাগিয়ে ডাইমন্ড শেইপ ফ্রেম। সাস্পেনশান লাগালে চাকা যে মুভমেন্ট করবে তার জায়গা ছিল না ফ্রেমে। যদিও ১৯১৩ সালে ইন্ডিয়ান মোটরসাইকেল কোম্পানি সাসপেন্ডেড সুইং আর্ম এবং লিফ স্প্রিং দিয়ে সাসপেনশন প্রথম ব্যবহার করে কিন্তু সামগ্রিক ভাবেই সে সময় রাস্তা বলতে আমরা যা বুঝি তা ছিল না তাই তা তেমন জনপ্রিয় হয়নি। সুইং আর্ম প্রযুক্তি এই সমস্যার সামাধান করে দিল। সুইং আর্ম প্রযুক্তির ফলে বাইকের ফ্রেমে , চাকা উপরে নিচে স্বাধীন ভাবে মুভমেনেটের জন্য যাথেষ্ট জায়গা পেয়ে গেলো। এই সুইং আর্ম প্রযুক্তি বাইকের পেছনের চাকার সাস্পেনশানের ক্রমান্বয়ের দুয়ার খুলে দিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতে এখন পর্যন্ত পেছনের চাকার সাস্পেনশান নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের সাস্পেনশান ব্যবহৃত হয়। আসলে সব সাসপেনশন বা শক এবজর্বরারের কাজ প্রায় একই। তবে মোটরসাইকেলের ডিজাইনগত ভিন্নতা এবং প্রডাকশন খরচের উপর নির্ভর করে সাসপেনশানের ধরন বদলে যায়। এই আলোচনায় আমরা মূলত বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত সাস্পেশান নিয়েই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। আমাদের দেশে সাধারণত নীচের সাস্পেনশান গুলোর ব্যবহারই বেশি দেখা যায়।
সামনের সাসপেনশন
- টেলিস্কোপিক সাসপেনশন
- টেলিস্কোপিক সাসপেনশন (আপ সাইড ডাউন)
পেছনের সাসপেনশন
- স্প্রীং লোডেড হাইড্রোলিক সাসপেনশন
- গ্যাস ফিলড বা নাইট্রক্স চার্জড শক এবজর্বার
- মনোশক এবজর্বার
টেলিস্কোপিক সাসপেনশন
মটরসাইকেলের সামনের চাকায় সাধারনতই টেলিস্কোপিক ফর্ক সাস্পেনশান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে একটি প্রাইমারি ব্যারেলের মধ্যে সাবলীল ভাবে মুভমেন্ট করার জন্য একটি স্লাইডার বার ঢুকানো থাকে । শক এভজর্ব করার জন্য ভেতরে একটি স্প্রিং এবং ফর্ক অয়েল থাকে। টেলিস্কোপিক সাস্পেনশান তিনটি ক্লাম্পের সাহায্য হ্যান্ডেলবারের সাথে ঝুলানো থাকে অপর প্রান্ত চাকার এক্সেলের সাথে যুক্ত থাকে। এর ফলে সমস্ত শক সিস্টেম সামনের চাকার সাথে যুক্ত হয়ে যায় । এতে করে চাকার মুভমেন্ট যেমন চমৎকার ভাবে করা যায় তেমনি বাইককে স্থিতিশীল রাখার জন্য হ্যান্ডেলও যথেষ্ট শক্ত থাকে।
টেলিস্কোপিক সাসপেনশন নিয়ে বিস্তারিত
টেলিস্কোপিক সাসপেনশন (আপ সাইড ডাউন)
টেলিস্কোপিক ফর্ককেই ব্যবহার করা হয় উল্টোভাবে। বাইরের স্লাইডারটি উপরে হ্যান্ডেলবারের সাথে লাগানো থাকে। ব্যবহারের সুবিধা হলো মোটরসাইকেলের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলে এবং মোটরসাইকেল কন্ট্রোলিংএ অধিক সুবিধা প্রদান করে। অসুবিধা হলো দাম বেশি এবং একটু দ্রুতই নষ্ট হয়। সাধারনত স্পোর্টস বাইকে এই ধরনের সাসপেনশনের ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
স্প্রীং লোডেড হাইড্রোলিক সাসপেনশন
প্রচলিত স্প্রিং লোডেড হাইড্রোলিক সাস্পেনশান নামেই বুঝতে পারছেন, কাজ করে হাইড্রোলিক নীতিতে। এই সাসপেশনশনের বেজ হিসাবে যে তরল ব্যবহার করা হয় তা ‘Damping Oil’ । এই তেল হাইড্রলিক পিস্টনের ভিতরে ঢুকানো থাকে এয়ার টাইট সিল দিয়ে। সাস্পেনশানের বাইরের দিকে একটা স্প্রিং থাকে এবং এর কাজ হলো , খানা-খন্দকের কারণে হাইড্রোলিক পিস্টন নিচে নেমে এলে তা আবার পুর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ‘Damping Oil’ বেজ সাসপেনশনের একটা সমস্যা আছে, আর তা হলো অতিরিক্ত ব্যবহারে এই তেল এক সময় ফোমে পরিণত হয় বা অন্য কথায় বলতে গেলে তেলের মধ্যে এক ধরণের বুদবুদের সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “Cavitation” । একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে পরিস্কার করি, একটা বোতলের মধ্যে তেল নিয়ে বোতলের মুখ বন্ধ করে জোরে ঝাকালে দেখবেন তেলের মধ্যে বুদবুদ তৈরি হচ্ছে। আসলে সব তেলের মধ্যেই ১০% গ্যাস মলিকিউল থাকে, অতিরিক্ত ঝাঁকালে বা সঙ্কুচিত করলে গ্যাসের মলিকুলের মধ্যে বন্ধন আলগা হয়ে যায় এবং বুদবুদ সৃষ্টি হয় ও অতি ব্যবহারে এক সময় ফোম আকার ধারন করে । এই ‘Damping Oil’ ফোমে রুপান্তরিত হতে অনেক সময় নিলেও বুদবুদ কিন্ত লং জার্নিতে এমনিতেই হয়, তাই এই ধরণের সাসপেনশানে লং জার্নিতে কার্যকরিতা কিছুটা হারায়। আমাদের দেশে লোয়ার সেগমেন্টের বাইকে এই ধরণের সাসপেনশন দেখা যায়। যেমন TVS Metro, Hero Splendor ইত্যাদি। এছাড়াও আমাদের দেশে কিছু সাসপেনশনে ডুয়েল স্প্রিং ব্যবহার হতে দেখা যায় যাকে “SNS” Sring n spring Suspension বা Dual spring suspension বলা হয়। যেমন Bajaj CT100 মোটরসাইকেলে এই ধরনের সাসপেনশন দেখতে পাবেন।TVS Phoenix এ দেখা যায় Series Spring Suspension কিন্তু মজার ব্যাপার সাসপেনশনের স্প্রিং কিন্ত শক এবজর্বে তেমন কোন কাজ করে না, স্প্রিং এর প্রধান কাজ হলো পিস্টনকে তার নিজের জায়গায় ফেরত পাঠানো। সাসপেনশানের পিস্টনের মধ্যে রক্ষিত তেল বা গ্যাস সংকুচিত হয়ে শক এবজর্বের মুল কাজ করে। তবে কোম্পানি দাবি করে এই ধরণের “ডুয়েল স্প্রিং” পিস্টনের মুভমেন্টকে মসৃণ করে ফলে আফটার শক ইফেক্ট অনেকটাই কমে যায়, এই বিষয়ে বিতর্কের অনেক সুযোগ আছে।
গ্যাস ফিলড বা নাইট্রক্স চার্জড শক এবজর্বার
Spring loaded hydraulic suspensions e তেলে ক্যাভিটেসান এর কারণে একদিকে যেমন সাস্পেনশানের টেকসই কম হয় অন্যদিকে তাৎক্ষনিক বুদবুদের কারণে লং জার্নিতে এর কার্যকরিতাও অনেকটা কমে যায়। এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে রেগুলার spring loaded hydraulic suspensions এ উচ্চ চাপে গ্যাস ভরা ক্যানেস্টার যুক্ত করে দেয়া হয়। সাধারণত নাইট্রজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয় বলে সাধারনভাবে “Nitrox” সাস্পেন্সান বলা হয়। এই উচ্চ চাপের গ্যাসের মুল কাজ হলো পিস্টনের মধ্যে তেলের ঝাঁকুনি নিয়ন্ত্রণ করে তেলের মধে বুদবুদ হতে বাধা দেয়া। এই প্রেসারাইজ গ্যাস, তেল ও গ্যাসের বন্ধন অক্ষুন্ন রেখে ক্যাভিটেশান রোধ করে ফলে দীর্ঘ যাত্রায় সাস্পেনশানের কার্যক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকে বুদবুদ হতে বাধা দেবার কারনে, পাশাপাশি উচ্চ চাপের গ্যাসের জন্য যে ক্যানেষ্টার ব্যবহৃত হয় তা একই সঙ্গে গ্যাস ও তেলের রিজার্ভার হিসাবে কাজ করে ফলে regular springer suspensions এর কার্যকারিতা বহু অংশে বাড়িয়ে দেয়। আসলে গ্যাস ফিল্ড ডাম্পার হোল regular springer suspensions এর আরও উন্নত প্রযুক্তি তা সে Monoshock version হোক বা dual suspensions ।
এভাবেই নাইট্রোজেন গ্যাস সমৃদ্ধ পিগিব্যাক ক্যানেস্টার একদিকে যেমন পেছনের সাস্পেশানের আয়ু অনেক বাড়িয়ে দেয় অন্যদিকে আপনার লং জার্নি নিরাপদ ও আরাম দায়ক হয়ে উঠে। তাই আপনার বাইকে যদি Nitrox filled shock absorbers থাকে তবে একটু বাড়তি প্রশান্তি পেতেই পারেন ; হাজার হলেও উন্নতর প্রযুক্তি আর চালানোর সময় বাড়তি আরাম আর নিরাপত্তা তো আছেই।
মনোশক এবজর্বার
আচ্ছা নতুন মডেলের স্পোর্টস বাইকে আপনি কি ডুয়েল সাস্পেনশান দেখেছেন? আমরা যেনো কল্পনাই করতে পারি না মনোশক ছাড়া একটা স্পোর্টস বাইক। এমন কি পালসার বা এপাচির মতো বাইক গুলি কেনো মনোশক ব্যবহার করে না , তা নিয়ে হয়ত অনেকেই বিতর্কে মাতি। তবে কমিউটার বাইকে কিন্তু আমরা মনোশক দেখি না, তার কারনও আছে, এই আর্টিকেলে পরে তা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্। যাই হোক কেনো স্পোর্টস বাইক সেগমেন্টে মনো শকের ব্যবহার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে? মনোশক কি ডুয়েল শকের থেকে ভালো? যদি তাই হয় তবে সব বাইকেই কেনো মন শক ব্যবহার করা হচ্ছে না?
আমাদের দেশে মনোশক তুলনামূলক নতুন যদিও বিদেশে স্পর্ট বাইক এবং হাই সেগমেন্টের বাইকে এর ব্যবহার অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এই তো অল্প কিছুদিন আগেও সাধারণ কমিউটার বাইক থেকে শুরু করে দামি সেগমেন্টের বাইকেও আমরা ডুয়েল বা টুইন শক দেখেই অভ্যস্থ ছিলাম। অভ্যাসের পরিবর্তন করে একটু ভিন্ন স্বাদ এনে দিল ইয়ামাহার নতুন ম্পোর্টস বাইকগুলি। পুরাতন চাল ভাতে বাড়ে। মনোশক দেখতে ভাল, স্টাইলিশ তাই বলে আপনি টুইন শক কে ছুড়ে ফেলতে পারবেন না; বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে অধিকাংশ রাস্তার অবস্থাই করুন। এই কারণে আপনি অধিকাংশ কমিউটার বাইকে ডুয়েল শক দেখবেন । ডুয়েলশক মানেই যে ভালো বিষয়টা তা নয়। মনে রাখবেন রাস্তা খারাপ মানে আপনার বাইকের চেসিস তথা সুইংআর্ম কে অনেক বেশী চাপ নিতে হয় এবং এই চাপ নেবার মতো একটা কার্যকরি শকআপ সিস্টেম আপনার বাইকের দরকার। হ্যা, মনোশকও এই কাজ পারে কিন্তু বাইকে যদি অতিরিক্ত ভার বহন করতে চান তবে ডুয়েল শকের বিকল্প নাই। ডুয়েল শক অনেক বেশী লোড নিতে পারে এবং লোড নেয়া অবস্থায় বাইকের স্ট্যাবিলিটি এবং শক এবজর্বের ক্ষমতার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। তবে উচ্চ গতিতে আপনি যদি হাইওয়েতে বাইক চালান তবে মনশকের জুড়ি মেলা ভার। আবার কর্নার নেবার সময় যেহেতু মনোশক সেন্টার অব গ্র্যাভিটির সাথে আপোষ করতে পারে তাই এই ক্ষেত্রে আপনি আনলিমিটেড কর্নারিং এবিলিটি পাবেন।
ডুয়েল শক এর সুবিধা
- অতিরিক্ত ভার বহনের ক্ষমতা
- শক এবজর্বের ক্ষমতা বেশী
- খারাপ রাস্তাতেও মসৃণ রাইডের নিশ্চয়তা দিবে
- মেইন্টেনেন্স খরচ কম
- চেসিসের উপরে লোড কমায়
ডুয়েল শক এর অসুবিধা
- উচ্চ গতিতে সুক্ষ কর্নার নেবার জন্য আদর্শ না
- হাই স্পিডে আপনার রাইডিং কন্ট্রোলকে কম্প্রোমাইজ করতে হবে
মনোশক এর সুবিধা
- কর্নার নেবার ক্ষমতা অনেক বেশী এবং হাইওয়েতে স্ট্যাবিলিটি ভালো
- রাস্তা মসৃণ হলে অতুলনীয়
- টিউন এবং এডজাষ্ট করা সহজ
- হ্যান্ডেলিং এবং রাইডিং এবিলিটি ভালো
মনোশক এর অসুবিধা
- দামে বেশী , মেন্টেনেস খরচও বেশী
- অতিরিক্ত ভার বহনে সক্ষম না
একটি ভালো সাসপেনশন বাইকারকে যেমন কমফোর্ট দিবে তেমনি রাইডিং এ দিবে ভালো কন্ট্রোল। প্রযুক্তির উন্নয়নে এবং সময়ের প্রয়োজনে সাসপেনশনের মান যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি ধরনও পাল্টেছে। প্রতিটি মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানই চেষ্টা করে বাইকে সর্বোচ্চ মানের সেরা সাসপেনশনযুক্ত করে রাইডারের সর্বোচ্চ আরাম এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। যদিও প্রয়োজন এবং দামের কারনে কখনও কখনও এ বিষয়ে কম্প্রোমাইজ করতেই হয়।