আপনার বাইকে কোন ইনজিনওয়েল ব্যবহার করবেন?
মোটরসাইকেল ইঞ্জিন অয়েলের কাজ ইঞ্জিন কে পিচ্ছিল রাখা যাতে সহজে ইঞ্জিনের পার্টস মুভমেন্ট হয়, ইঞ্জিন কে ঠান্ডা রাখা, ইঞ্জিন চলার ফলে যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ময়লা হয় তা পরিস্কার করে ইঞ্জিন কে সঠিকভাবে চলতে দেয়া যাতে সঠিক আউটপুট পাওয়া যায়। যদিও আমাদের দেশে ইনজিন ওয়েল মবিল নামেই বেশি পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে মবিল হলো ইনজিন ওয়েলের একটি ব্রান্ড। এই ব্রান্ডটি আমাদের দেশে এতোটাই জনপ্রিয় এবং পরিচিত যে আমরা ইনজিনওয়েলকেই মবিল বলে থাকি। ইনজিন ওয়েল আরো কয়েকটি নামে পরিচিত যেমন মোটরওয়েল বা ইনজিন লুব্রিকেন্ট ইত্যাদি।
ইনজিনওয়েলের ব্যবহার
ইনজিনওয়েল ইনজিনের ভেতরে তিনটি প্রধান কাজ করে থাকে। প্রথমত লুব্রিকেন্ট বা পিচ্ছিলকারক হিসেবে ইনজিনের ভেতরের যন্ত্রগুলোত চলতে বা ঘুরতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ঘর্ষনে এবং কম্বাশনের ফলে উৎপাদিত তাপকে কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে।তৃতীয়ত ইনজিনের ভেতরে ময়লাগুলোকে পরিস্কারে সাহায্য করে, পিস্টন রিং ও সিলিন্ডারের মধ্যে লিকপ্রুফ হিসেবে কাজ করে যাতে কম্প্রেশন লিক না হয়।
মোটরসাইকেলের ইনজিনের মধ্যে অনেকগুলো ধাতব যন্ত্রাংশ থাকে যা একটির সাথে আরেকটি কখনো দাতযুক্ত গিয়ারে লেগে থাকে, কখনও ঘুরতে থাকে বা কোনটি ঘষা খায়। যেমন চালু অবস্থায় ইনজিনের পিস্টনটি একটি সিলিন্ডারের ভেতরে প্রচন্ডজোরে উপরে নিচে উঠা নামা করতে থাকে। পিস্টনের রিংগুলো সিলিন্ডারের গায়ে তীব্রবেগে ঘষা খেতে থাকে। যাইহোক এই ধরনের ঘর্ষনজনিত ক্ষয়রোধ এবং ইনজিনকে গতিশীল রাখতে লুব্রিকেন্ট সাহায্য করে।
ইনজিনের ভেতরে যন্ত্রাংশগুলোর ঘর্ষনে তাপ তৈরী হয় এছাড়াও ইনজিন সিলিন্ডারে যেখানে জ্বালানি পুড়তে তাকে সেখানে প্রচন্ড তাপ তৈরী হয়। এই ধরনের তাপকে কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে ইনজিন ওয়েল।
এছাড়াও ক্লাচ সিস্টেম ও গিয়ারবক্সের পিচ্ছিল্করনে ও তাপ দূরীভূতকরনেও ইঞ্জিন ওয়েলের ভুমিকা আছে।
প্রতি ৮০০-১০০০কিমি অন্তর ইনজিন ওয়েল পরিবর্তন করা জরুরী। প্রথমত এই পরিমান পথ চললে এমনিতেই ইনজিনওয়েল কার্যকারীতা কমে যায়, দ্বিতীয়ত ইনজিনের ভেতরে ঘষর্ন বা অন্য কারনে জমে থাকা ধাতব কনা বা ময়লা পরিস্কারের প্রয়োজন পড়ে।
ইনজিনওয়েলের ধরন
মোটরসাইকেলের জন্য সাধারনত দুই ধরনের ইনজিন ওয়েল ব্যবহার হয়। একটি হলো খনিজ বা Mineral. যেটি প্রাকৃতিক উপায়ে খনি থেকে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ থেকে আসে। আরেকটি কেমিক্যাল থেকে তৈরী করা হয় যা কৃত্রিম বা সিনথেটিক ইনজিন ওয়েল। বাস বা কারের ইনজিন ওয়েল কখনই মোটরসাইকেলের উপযোগী নয় এবং বর্তমানে সকল মোটরসাইকেলই ৪স্ট্রোক বিশিষ্ট। তাই যেসকল ইনজিনওয়েলের প্যাকেটে 4T লেখা আছে শুধু সেগুলোই ব্যবহার করতে হবে। এগুলো ৪স্ট্রোক ইনজিনের জন্যই প্রযোজ্য। মিনারেল ইনজিন ওয়েল সাধারনত প্রতি ৮০০কিমি থেকে ১০০০কিমি অন্তর পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। সিনথেটিক ইনজিনওয়েল সাধারনত মিনারেলের থেকে বেশি সময় কার্যকর থাকে। লক্ষ্য রাখবেন মোটরসাইকেল ইঞ্জিনে তিনটি ইউনিট থাকেঃ ইঞ্জিন, ক্লাচ সিস্টেম, গিয়ারবক্স কিন্তু অন্যান্য বড় বাহনে ইঞ্জিন, গিয়ারবক্স, ক্লাচ আলাদা আলাদা ইউনিট হিসেবে কাজ করে। তারমানে হচ্ছে মোটরসাইকেল ইঞ্জিন অয়েলের এমন গুন থাকতে হবে যা একই সঙ্গে ইঞ্জিন, গিয়ারবক্স ও ক্লাচ সিস্টেমে ভালো ভাবে কাজ করবে। কিন্তু অন্যান্য বাহনের ইঞ্জিন অয়েল শুধুমাত্র ইঞ্জিন ইউনিটে ব্যবহারের জন্য প্রস্তত। কাজেই মোটরসাইকেল ইঞ্জিন অয়েল কেনার সময় লক্ষ্য রাখবেন তা শুধু মোটরসাইকেলের জন্যই প্রস্তত কিনা। কিভাবে বুঝবেন ইঞ্জিন অয়েলের ক্যান বা বোটলের গায়ে লেখা থাকবে ইহা মোটরসাইকেলের জন্য প্রস্তত। স্কুটারের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ প্রযোজ্য। কাজেই যে ইঞ্জিন অয়েল মোটরসাইকেলের জন্য নয় তা কখনোই ব্যবহার করবেন না। কারন ইহা মারাত্নক ক্ষতিকর।
ইনজিনওয়েলের গ্রেড
Society of Automotive Engineers (SAE) কর্তৃক মোটরসাইকেল ইনজিন ওয়েলের নম্বর ভিত্তিক গ্রেড নির্ধারন করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের ইনজিন ওয়েল বিভিন্ন গ্রেডের হয়ে থাকে। গ্রেডের মাধ্যমে মুলত ইনজিন ওয়েলের ঘনত্ব(Viscocity) ও কেমন আবহাওয়ায় কোন যানের জন্য প্রস্তত তা বুঝিয়ে থাকে। গ্রেড সিংগেল এবং মাল্টি দুটিই হতে পারে। আমাদের দেশে মাল্টিগ্রেড ইনজিন ওয়েল ব্যবহার করা হয়। মাল্টি গ্রেড মার্কের দুটি অংশ থাকে। প্রথম অংশটি কমতাপামাত্রায় কার্যকারিতা নির্দেশ করে যেমন 20W, 10W ইত্যাদি। মান যত কম হবে ততো কম তাপমাত্রায় অর্থাত বেশি শীতে কাজ করবে। আর পরের অংশটি গরম বা বেশি তাপ নির্দেশক। যেমন 30, 40, 50 ইত্যাদি। এই মান যত বেশি হবে ততো বেশি তাপে বা বেশি গরমকালে কাজ করবে। সহজ কথা এই গ্রেড নির্দশকের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কোনসময়ে কোনটি ইনজিনওয়েলটি ব্যবহার করবো। আমাদের দেশে সাদারনত 10W-30, 20W-40, 20W-50 ইত্যাদি গ্রেড দেখা যায়। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে মোটরসাইকেলের কোম্পানীকতৃক নির্ধারিত গ্রেডের ইনজিনওয়েল ব্যবহার করাই সবচাইতে উত্তম।
ইনজিনওয়েলের মান(Standard)
কিছু প্রতিস্ঠানের মানকে ইনজিনওয়েলের জন্য নির্ধারিত হয়ে তাকে যেমন API (American Petroleum Institute), JASO (Japanese Automotive Standards Organization ), ILSAC (The International Lubricant Standardization and Approval Committee), ASTM (American Society for Testing and Materials) ইত্যাদি।
জনপ্রিয় ব্রান্ড
বাংলাদেশে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ইনডিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে ইনজিন ওয়েল আমদানী হয়ে থাকে।প্রচলিত অনেক ব্রান্ড রয়েছে যারা জনপ্রিয় তাদের মধ্যে Shell, Mobil, Petronas, Fuchs, ENEOS, Caltex, Visco, BP, Total, Cepsa, Valvoline, Lukoi, Motul, Havoline ইত্যাদি।
কোথায় থেকে কিনবেন
নকল ইনজিন ওয়েল নিয়ে আক্ষেপ সবারই। অনেক দোকান থেকে প্যাকেটজাত বা কৌটাতে ইনজিন ওয়েল কেনার পরেও নকল পেয়েছেন বলে জানা যায়। সঠিক ইনজিন ওয়েল পেতে ঐ ব্রান্ডের নির্ধারিত ডিলার বা সেলস সেন্টার থেকে কিনুন। রাস্তার ধারের খোলা ইনজিন ওয়েল বা অপরিচিত দোকান থেকে ইনজিন ওয়েল কেনা থেকে বিরত থাকুন। আপনার এলাকার পরিচিত ও বিশ্বস্ত দোকান থেকেই সিল চেক করে কিনুন বা সরাসরি ডিলারের কাছ থেকে। মনে রাখবেন যেটা ভেজাল সেটা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন।
সতর্কতা
বাইকে খোলা ইনজিন ওয়েল ব্যবহার করবেন না। ইনজিন ওয়েলে কৌটা থেকে ঢেলে কৌটাটি ফুটো করে দিন বা নষ্ট করে দিন। কেননা অনেক অসাধু ব্যক্তি ব্যবহৃত ভালো কৌটা সংগ্রহ করে তাতে নতুনভাবে নকল ইনজিন ওয়েল ভর্তি করে বিক্রি করে থাকে। হয়তো আপনি নিজেই হবেন সেই ক্রেতা। সামান্য অসতর্কতায় আপনার লক্ষ টাকার বাইক নষ্ট হবে।
সমাপ্তি
শুধুমাত্র ভালো ব্র্যান্ড বা দাম দেখে কখনও ইনজিনওয়েলকে বিচার করতে যাবেন না। কোম্পানী কর্তৃক নির্ধারিত গ্রেডের ইনজিনওয়েল ব্যবহার করুন। মানের জন্য স্টান্ডার্ড কোম্পানীকতৃক সার্টিফায়েড ব্র্যান্ডগুলোকে বেছে নিবেন। অপরিচিত ব্র্যান্ডের বা যার কোন অনুমোদিত আমদানিকারক নাই বাংলাদেশে বসে সব ব্র্যান্ডের ইঞ্জিন অয়েল কিনে প্রতারিত হবেন না। রাস্তার পাশের অনির্ভরযোগ্য বা খোলা ইনজিনওয়েল ব্যবহার করবেন না। ভালোমানের ইনজিনওয়েল আপনার বাইকের ইনজিন দীর্ঘদিন ভালো রাখবে।